শাহীন খান »
পিচ্চি প্রজাপতিটা আজ তিন দিন ধরে না খেয়ে আছে। কোনো দানা-পানি জোটেনি তার ভাগ্যে ! ভীষণ অসুস্থ সে। অপূর্ব সোনামাখা যাদুমাখা চাঁদ বদনী মুখখানি দুখের কালো মেঘে ঢেকে আছে! ঝিকমিক অনাবিল মখমল ডানা দুটোর অধিকাংশই ভাঙা ! ভেঙে গেছে চিরতরে তার স্বপ্ন সাধ আশা। ভেঙে দিয়েছে দুষ্টু পাজির দল ছেলে ছোকরারা। তার মা বাবা ওদের হাতেই মারা পড়েছে !
মা বাবার কথা মনে আসা মাত্রই চোখে শ্রাবণের ঢল নেমে এলো।
তখন শরৎকাল। কাশ ফুলে ভরে গেছে সন্ধ্যা নদীর দু কুল। বাগান জুড়ে মৌ মৌ নানান ফুলের সুরভী ! পাখিরা দোল খায় বাতাসে। কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে দূর দেশে। অতিথি পাখিরা নিজের দেশ ছেড়ে এ দেশে বেড়ানোর উদ্দ্যেশে কেবল মাত্র ডানা মেলেছে। থেকে থেকে ঘুঘু আর বউকথা কও ডেকে চলছে। নীলাম্বরী শাড়ী পরে আছে আকাশের কিছু অংশ। নীলিমার বুক জুড়ে জেগেছে স্বপ্নময় রঙধনু। রাতে চাঁদ ও তারা মাতে জোছনার প্লাবনে। জোনাক পোকা ঝোপঝাড়ে নেভে আর জ্বলে । সব মিলে মায়াবী লাগছিলো গোটা দেশকে।
তো, একদিন, উদাস বিকেলে পিচ্চি প্রজাপতি মা বাবার কাছে বায়না ধরলো তাল পুকুরের পার্শ্বে যে বাগান বাড়িটা আছে সেখানে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য। মা প্রজাপতি তার দুগালে আর মাখা পরশ দিয়ে বললো, লক্ষ্মী সোনা, ওখানে ভুলেও আমাকে যেতে বলো না, তুমিও না বলে, না কয়ে কক্ষণো যেও না। ওখানে সব সময় দুষ্টু ছেলের দল ঘুরঘুর করে। পাখিরা মারা পড়ে, গুঁইসাপ ধাওয়া খায়, ফড়িং, ভ্রমর, মৌমাছি এমন কী পিচ্চি পিঁপড়ে পর্যন্ত ঢুকতে পারে না। খুব বেশি ভয় পায়! অতঃপর সে তার বাবার কাছেও বায়না ধরলো। বললো, ও বাবা, আমার যাদু বাবা, চলোনা ঐ বাগানটায়। কতো সুন্দর ফুল ফুটে আছে । ঘ্রাণে বাতাস মুখরিত হচ্ছে, প্লিজ সোনা বাবা, আমাকে নিয়ে চলোনা ! বাবা বললো, ও সোনামা , মা রে, অমন বায়না ধরো না, যাতে আমাদের জীবন চলে যায়। ওই বন হলো আমাদের জন্য মৃত্যু ফাঁদ। ওখানে আমরা কস্মিনকালেও যাই না, ভুল করেও মাড়াই না। ওই বন হলো আমাদের জন্য অভিশাপ ! তার চেয়ে এসো আমরা লুকোচুরি খেলি। পিচ্চি প্রজাপতি আর কথা বাড়ালো না। মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। পিচ্চি প্রজাপতি আর তার প্রজাপতি বাবা লুকোচুরি খেলা শুরু করলো ।
তখন গোধুলি বেলা। রাখাল গরুর পাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। হাটুরে হাট থেকে থলে ভর্তি সদায় নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি আসছে। ইমাম সাহেব, মুয়াজ্জিন আর নামাজিরা মসজিদ সংলগ্ন পুকুরে ওযু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঠিক এমন সময় পিচ্চি প্রজাপতিটা খেলতে খেলতে তালপুকুরের পার্শ্বের বাগানে আনমনা হয়ে ঢুকে পড়লো। আর যায় কোথায়! দুষ্টু ছেলেরা তাকে ধরার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেলো। পিচ্চি প্রজাপতি খুব বেশি ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে একটি বাবলা গাছের ওপর আশ্রয় নিলো। সেখানেও একটি দুষ্টু ছেলে একটি লাঠিতে আঠা লাগিয়ে তাকে ধরতে চেষ্টা করলো কিন্তু সে একটুর জন্যে ধরা পড়লো না , ভাগ্যিস লাঠিটা একটি ডালে ধাক্কা খেলো ! নয় তো সে অনায়াসেই ধরা পড়তো । ঠিক এমন সময় অন্য আর একটি ছেলে ঢিল ছুঁড়লো। পিচ্চি প্রজাপতি কোনো রকম উড়াল দিয়ে একটি ডোবার পাশে গিয়ে পড়লো। বড় বেশি ভয় পেয়ে সে তার মা, বাবাকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো, দিশে হারিয়ে কাঁদতে লাগলো। পিচ্চি প্রজাপতির কান্না মা বাবার কানে পৌঁছানো মাত্রই তারা কাঁদতে কাঁদতে উড়াল দিয়ে অভিশপ্ত বাগানে ঢুকে তাকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো, পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো। এক পর্যায় তারা দু‘জনেই পথ হারিয়ে ফেললো। বিছিন্ন হয়ে গেলে একে অপরের কাছ থেকে। এদিকে পিচ্চি প্রজাপতি কোনো রকম কষ্টেশিষ্টে বাড়ির দিকে উড়াল দিতেই তার ছোট্ট ডানা দুটো বাড়ি খেলো একটি রেন্টি গাছের ডালে, সঙ্গে সঙ্গে একটি ডানা ভেঙে গেলো অপরটি গেলো মচকে। মাগো রে বাবা রে বলে জ্ঞান হারালো!
এদিকে দুষ্টু ছেলের দল পিচ্চি প্রজাপতির বাবা মাকে দেখা মাত্রই আঁঠালো লাঠিটা আচমকা তাদের ডানা বরাবর ছোঁয়াতেই আটকে গেলো। তারা ধরা খেলো। ধরা খাওয়ার পরও তাদের মন সন্তানের জন্য আরো বেশি ছটফট করতে লাগলো, খুব বেশি কাঁদতে লাগলো। আসন্ন মৃত্যুর কথা পর্যন্ত তারা ভুলে গেলো। প্রতিশোধ নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। ঠিক এমন সময় পিচ্চি প্রজাপতি জ্ঞান ফিরে পেলো। সে তার বাবা মাকে কান্না জড়িত কণ্ঠে ডাকতে লাগলো। আহত শরীর নিয়ে কিছু দূর যেতেই তার মা বাবাকে দেখা মাত্রই ডাক দিলো। ওর মা, বাবা ওর ডাকে সাড়া দিতেই দুষ্টু ছেলের দল পিচ্চি প্রজাপতির বাবা মায়ের ডানা দুটো ছিঁড়তে হাত বাড়ালো। ঠিক এমন সময় দুষ্টু ছেলের একটিকে পিচ্চি প্রজাপতির মা ও বাবা কাঁমড়ে দিতেই অন্য ছেলেরা পিচ্চি প্রজাপতির সামনেই তার বাবা মা‘র মাথা শরীর থেকে আলাদা করে ফেললো! পিচ্চি প্রজাপতি বাবা রে, মাগো রে বলে কেঁদে কেঁদে পুনরায় জ্ঞান হারালো !
ঠিক তিন দিন পর আজ তার জ্ঞান ফিরে আসায় নিজেকে ধিক্কার জানালো ! যদি বাবা মার লাশ পাওয়া যায় এই আশায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঠিকানাবিহীন চলতে লাগলো আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
ছ‘বছরের বীণা নামের একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে, যে কিনা প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। সে পিচ্চি প্রজাপতির পথ দিয়েই স্কুলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ সে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো। সামনে এগুতেই পিচ্চি প্রজাপতিকে কাঁদতে দেখলো। পিচ্চি প্রজাপতি বীণাকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো এবং অনুনয় করে বলতে লাগলো আমাকে মেরো না, প্লিজ আমাকে মেরো না, আমরা তো কারুরই ক্ষতি করি না, তবে কেন আমাদের শুধু শুধু মেরে ফেলো ? আমাদের কী এমন ভুল কী এমন দোষ পেলে যার কারণে আমার বাবা মাকে এতো নির্মমভাবে হত্যা করলে ? মারার যখন এতোটাই শখ তবে এই নাও আমাকেও মেরে ফেলো। পিচ্চি প্রজাপতির এমন কান্না জড়িত কথা ছোট্ট বীণার অবুঝ মনে দাগ কেটে গেলো। সে অভয় দিয়ে বললো, না না বন্ধু আমি তোমাকে মারবো না। তোমার কান্না আমাকে কাঁদিয়ে ফেলেছে, তোমার দুখে আমি মর্মাহত! তোমার কষ্ট আমার বুকে বেদনা ছড়াচ্ছে। জানো, আমার মা, বাবাও আমাক ছেড়ে দূর আকাশের তারা হয়ে আছে। এই দেখো আমি তো কাঁদছি না। এই বলে সে খুব জোরে কেঁদে দিলো এবং বললো, আমি লেখাপড়া করে তাদের স্বপ্ন সত্যি করবো এবং করতে চাই।
পিচ্চি প্রজাপতি দেখলো বীণা তারই মতো দুখি। বীণার সাথে সে সই পাতালো। তারপর তারা পরম সুখে একই সাথে জীবন কাটাতে লাগলো।