প্রচলিত ইটভাটা : পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি

সাধন সরকার »

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালিত হয়েছে ‘বিশ^ বসতি দিবস’। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য আবাসন: ভবিষ্যতের উন্নত নগর’। এ দিবসটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব আবাসনই টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সাধারণত ইট পুড়িয়ে পাকা ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে! ইতিমধ্যে পৃথিবীর বহু দেশে এমনকি আমাদের দেশেও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বা উপাদান ব্যবহার করে বসতি তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহার করে বসতি তৈরির বিষয়টি সম্পর্কে যদি সবাইকে সচেতন করা যেত তাহলে এ ধরণীতে সমগ্র প্রাণিকুলের বসবাস আরও টেকসই, নিরাপদ ও সুন্দর হতো।
নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নির্মাণকাজ। আর নির্মাণকাজের অন্যতম অনুষঙ্গ ইট। উন্নয়নের সাথে দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ইটের চাহিদা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে ইট তৈরিতে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে পরিবেশ, কৃষিজমি ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পবা’র (পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এসব ইটভাটায় প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি ইট ও ব্রিকেট উৎপাদিত হয়। এ খাতে ২০ লাখেরও বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান জড়িত, যাদের বড় একটা অংশই নারী। বহু বছর ধরে এদেশের ইটভাটাগুলোতে সনাতন পদ্ধতিতে ইট প্রস্তুত হয়ে আসছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে উন্নততর, কম দূষণকারী ও আধুনিক প্রযুক্তিতে ইট প্রস্তুত করার। বর্তমানে ইট প্রস্তুত করতে দেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষিজমি ও প্লাবনভূমির মাটি কেটে ফেলা হচ্ছে। আবার ইটভাটাগুলোতে অবৈধ ড্রাম চিমনি ও কম উচ্চতার চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছে। আইন থাকলেও বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ হচ্ছে বলে মনে হয় না! আর হলেও তা কালেভদ্রে! মূলত ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষিজমির ওপরের জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি ইটভাটায় ব্যবহৃত হওয়ায় জমির উর্বরতা বিনষ্টের ফলে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ইটভাটা থেকে দূষিত গ্যাস ও তাপ আশপাশের জলাভূমি, জীবজন্তু, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। দেশের শত শত ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে অবৈধভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ফলে উজাড় হচ্ছে বন-জঙ্গল-বৃক্ষ। এতে বিনষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, চিরচেনা প্রকৃতি ও পরিবেশ। পরিবেশদূষণ রোধে সরকার ২০১২ সালে ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিলেও তা কাজে আসেনি। নিয়ম না মেনে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স না নিয়ে যেখানে-সেখানে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। বলতে গেলে দেশের অর্ধেক ইটভাটায় অবৈধ! আইনের তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন ও সালফার নিঃসরণ, বসতবাড়ি, কৃষিজমি, টিলাসংলগ্ন সমতলে ইটভাটা স্থাপন ও বন উজাড়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি মাটির ইটের বিকল্প হিসেবে যেসব উপকরণ ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে তার ব্যবহার বাড়াতে হবে।
ইটভাটার জন্য মাটি তুলতে ‘পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার’ (ইআইএ) ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
বাংলাদেশে সাধারণত এখন দুই পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন করা হয়ে থাকে : পুড়িয়ে, আর না পুড়িয়ে। যদিও না পুড়িয়ে ইট উৎপাদন ও ব্যবহার একেবারেই কম! না পোড়ানো ইটের ক্ষেত্রে বালু, সিমেন্ট, ফ্লাই অ্যাশ, জিপসাম ইত্যাদি মিশ্রিত করে ফোমিং এজেন্টের সাহায্যে জমাট বাঁধিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। না পোড়ানো ইট তৈরিতে মাটি ও কয়লা, কাঠ বা অন্য কোনো জ¦ালানির ব্যবহার নেই। বাংলাদেশে পোড়ানো ইটের ক্ষেত্রে ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ভাটা, ভার্টিক্যাল ভাটা, টানেল ভাটা, জিগজ্যাগ প্রভৃতি ধরনের ভাটা দেখা যায়। এদের মধ্যে ড্রাম চিমনি ও জিগজ্যাগ ভাটায় সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণ হয়ে থাকে। টানেল ভাটায় আধুনিক মেশিনের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইট প্রস্তুত করাই ও কয়লার ব্যবহার কম হওয়ায় পরিবেশদূষণ কম হয়। আবার জিগজ্যাগ ভাটার ক্ষেত্রে ইট বসানো ও পোড়ানোর কৌশল পরিবর্তন করে পরিবেশদূষণ হ্রাস করা সম্ভব। এ ছাড়া মাটির ইট তৈরিতে ভূমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে নদীর তলদেশের মাটি ব্যবহার করতে পারলে নদ-নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা যেমন সম্ভব হবে তেমনি মাটির চাহিদাও মিটবে।
এককথায় আধুনিক ও টেকসই ইট প্রস্তুত তৈরিতে জোর দিতে পারলে জ¦ালানির সীমিত ব্যবহার, পরিবেশদূষণ রোধ, কৃষিজমি, ভূ-উপরিস্থিত মাটি ও পানির ব্যবহার কমানো সম্ভব হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফাঁপা ও না পোড়ানো ইটের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব অনেক নির্মাণসামগ্রী (ফাঁপা ও না পোড়ানো ইটসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী) উৎপাদন হলেও না জানা ও উৎসাহের অভাবের কারণে এর ব্যবহার করা হচ্ছে না। পরিবেশের দূষণ রোধ, শ্রমিকস্বার্থ রক্ষা, কৃষিজমি রক্ষা ও সর্বোপরি জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় আধুনিক প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিদ্যমান ইটভাটাগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে। ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ইটে তৈরি বাড়ি ও স্থাপনা হোক টেকসই, মজবুত, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ।
পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী তৈরির বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা, উদ্যোগ, প্রচার ও প্রসারই পারে দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুত ও এর ব্যবহারের মাধ্যমে সমৃদ্ধির আগামীর দেশ গড়তে।

লেখক : পরিবেশকর্মী
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স