‘পুনর্বাসন নয়, নিজ ঘরই হোক বয়স্কদের আশ্রয়’

আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস আজ

হুমাইরা তাজরিন »

বাংলাদেশে প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, ‘বর্তমান সরকার যদি পুনরায় ক্ষমতায় আসে তাহলে আমার অনুরোধ থাকবে বয়স্কদের আলাদা কোথাও পুর্নবাসন না করে যাতে তাদেরকে নিজ ঘরে রেখেই সার্বিক সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়। এ জন্য ওল্ড এইজ হেল্পিং এবং কো-অপারেশন বা ইন্সটিটিউট নামে সরকারের পক্ষ থেকে বৃদ্ধকালীন সহযোগিতার সংগঠন চালু করা যেতে পারে। যেখানে বয়স্কদের নিজ ঘরে থাকা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যসেবাসহ প্রয়োজনীয় সেবাগুলো পরিবেশন করবে।’

এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার বয়স্করা যাতে পারিবারিকভাবে অবহেলার শিকার না হয় সেজন্য আইন প্রণয়ন করেছে। বয়স্কের মাসিক একটি ভাতা ব্যবস্থা করেছে। তবে আমাদের সম্পদের পরিমাণ কম হওয়ায় সে অর্থে আমরা বয়স্কদের সাহায্য করতে পারছি না। আমাদের দেশে যে বৃদ্ধাশ্রমগুলো আছে সেগুলো অনেকটা পশ্চিমা ধাঁচেরই। উন্নত দেশে যে বয়স্কদের অবস্থা আমাদের দেশের চাইতে ভালো তাও না। তাদের বৃদ্ধাশ্রমের যে সিস্টেম সেটাকে আমি যথাযথ বলে মনে করি না। ওখানকার বেশিরভাগ সন্তানেরা বিশেষ দিনগুলোতেই মা-বাবাকে ফোন করেন বা দেখা করেন। অনেক সময় বয়স্করা ঘরের ভিতর মরে পঁচে থাকেন কেউ জানেওনা।’

আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ১৯৮২ সালে ওর্য়াল্ড অ্যাসেম্বলি অন এজিং দ্বারা ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাান অফ অ্যাকশন অন এজিং নামের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো। তারপর ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে মনোনীত করে। ১৯৯১ সালে সাধারণ পরিষদ বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য জাতিসংঘের নীতি গ্রহণ করে (রেজুলিউশন)। ২০০২ সালে ২১ শতাব্দীতে সমাজে বসবাসরত বয়স্কদের বার্ধক্যের সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে উন্নয়ন সাধনের জন্য ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান অফ অ্যাকশন অন এজিং গৃহিত হয়।

এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার প্রতিশ্রুতি পূরণ : প্রজন্মব্যাপী’
জাতিসংঘের মতে, উন্নত দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিদের প্রবীণ বলা হয়ে থাকে। তবে উন্নয়নশীল দেশে ৬০ বছর বয়স থেকে প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন।

জাতিসংঘের মতে, ২০২১ সাল থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ হবেন প্রবীণ ব্যক্তি। ২০২২ সালে যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করবে তারা ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তিদের তুলনায় ২৫ বছর বেশি বাঁচবেন বলে জানা যায়। বর্তমানে নারীদের গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় ৪ বছর বেশি ।

বাংলাদেশ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ ( ৯.২৮) প্রবীণ। সংখ্যায় যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৫৩ লক্ষ ২৬ হাজার ৭১৯ জন। ২০১১ সালে যে হার ছিলো ৭.৪৭ শতাংশ। মূলত গড় আয়ু বাড়ার ফলে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। জাতিসংঘের মতে, আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ বয়স্ক ব্যক্তিদের এই সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি।

সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও প্রায়ই অন্যদের মতো সুযোগ পান না প্রবীণেরা। পারিবারিকভাবেও হন অবহেলিত। এর কারণ হিসেবে উপার্জন কম থাকা, শরীরিক শক্তি কমে যাওয়া, শারীরিক নির্ভরশীলতা, অসুস্থতা ইত্যাদি বিষয়গুলো কাজ করে। বয়সের সাথে সাথে স্থায়ীভাবে শরীরে বাসা বাঁেধ কিছু শারীরিক অসুখ। যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, ডায়বেটিক, হৃদরোগ, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এই বয়সের মানুষদের মাঝে দেখা দেয় সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, ঘুমের সমস্যা, স্মৃতিবৈকল্যসহ (ডিমেনশিয়া) বিভিন্ন মানসিক রোগ। এর কারণ হিসেবে কর্মজীবন থেকে অবসর, সন্তানদের সাথে দূরত্ব, পাওয়া না পাওয়ার হতাশা, অবহেলা-অযতœ, শারীরিক কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়।

ক্রমশ ছোট হয়ে আসা অনু পরিবারগুলো আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও বয়স্ক নির্ভরশীল ব্যক্তির দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়। যার কারণে বৃদ্ধাশ্রম কনসেপ্টের উদ্ভব হয়। বৃদ্ধাশ্রমের নির্মম বাস্ততবতা মনে করিয়ে দেয় সমাজের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের কথা। যাদের মাধ্যমে পৃথিবীর আলো দেখা, যাদের হাত ধরে বিশ্বজয় একসময় তারাই হয়ে দাঁড়ায় পথের কাঁটা। যেন উপড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচা যায়। তবে বৃদ্ধাশ্রমের মতো নিরাপদ স্থানে জায়গা হচ্ছে নগণ্য বয়স্কদের। বেশিরভাগই অনাহারে অনাদরে দিনাতিপাত করছেন। কারো কারো সন্তান-পরিজনেরা রাস্তাঘাট বনে জঙ্গলে ফেলে যাচ্ছেন তাদের।

পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচীন চীনে। সেখানে শান রাজবংশ সহায়হীনদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিল। বাংলাদেশ সরকার কতৃর্ক ৬টি বিভাগে ৬টি বৃদ্ধাশ্রম ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বাগেরহাট, বরিশাল ও সিলেট জেলায় অবস্থিত। দেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা মোট ৩২টি।

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে রাবেয়া বশরী বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্র নামে একটি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে।

২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মাসিক বয়স্ক ভাতা ৫শ’ টাকা থেকে ৬শ’ টাকা পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে। এই ভাতা ভোগ করবেন প্রায় ২৬ লাখ প্রবীণ।