পাহাড়ে জঙ্গি শিবিরে বিদ্রোহ

পাহাড়ি সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর

সুপ্রভাত ডেস্ক »

নতুন যে জঙ্গি দলটি পাহাড়ে আস্তানা গেঁড়েছিল, তাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে বিদ্রোহ হয়, যে জন্য শাস্তির মুখেও পড়তে হয়েছিল কয়েকজনকে; আবার সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে পাহাড়ি একটি সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহতও হন। ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে জড়িত অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) বৃহস্পতিবার এই খবর দিয়েছে। খবর বিডিনিউজের।

এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই জঙ্গি দলের ভেতরকার এই খবর দিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এটা ‘বিরাট এক গল্প’।

পাহাড়ে ‘হিজরত’ করে এক বছরের বেশি সময় জঙ্গি শিবিরে থাকা ওই দুজনকে বুধবার গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তারা হলেন- সিলেটের মাদ্রাসাছাত্র সাইফুল ইসলাম তুহিন (২১) ও ঢাকার শেরেবাংলা নগরের এগ্রিকালচার ট্রেইনিং ইনস্টিটিউটের (এটিআই) ছাত্র নাঈম হোসেন (২২)।

আসাদুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার দুজন হিজরতের প্রেক্ষাপট, পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং সেখানে ফেরত আসার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে।

হঠাৎ বাড়ি ছাড়া কিছু তরুণের খোঁজ করতে গিয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন জঙ্গি দলের খবর প্রথম জানিয়েছিল র‌্যাব। এই সংগঠনটির সঙ্গে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (বম পার্টি) যোগসাজশের কথাও জানানো হয়েছিল।
র‌্যাব জানিয়েছে, ঘর ছাড়া ৫৫ তরুণের মধ্যে ৩৮ জনকে তারা চিহ্নিত করেছে এবং তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। এই পর্যন্ত ওই জঙ্গি দলের ৩০ জনের মতো সদস্যকে গ্রেফতারের কথা জানায় র‌্যাব।

এর মধ্যে এই জঙ্গি দলের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের ছেলে সাদিক সাইফুল্লাহ রাফাতসহ দুজনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। এরপর শফিকুরকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এখন আরও দুজনকে গ্রেফতারের খবর দেওয়া হল।

সংবাদ সম্মেলনে আসাদুজ্জামান বলেন, পাহাড়ে ‘হিজরত’ করে এক বছরের বেশি সময় ক্যাম্পে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এরকম দুজনকে বুধবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ‘হিজরতের’ প্রেক্ষাপট, পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং সেখান থেকে ফেরত আসার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে।

‘সকলে যে স্বপ্রণোদিত হয়ে ক্যাম্পে ছিল এমনটা নয়। হিজরতটাও পুরোটাই যে স্বপ্রণোদিত হয়ে করেছে তা নয়। অনেককে বিভ্রান্ত করে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু একবার ক্যাম্পে ঢোকার পর অনিচ্ছা থাকলেও তাদের ফেরার আর কোনো পথ ছিল না।’

সিটিটিসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাইফুল ইসলাম তুহিন তাবলিগে যাওয়ার কথা বলে গত বছরের ১৫ নভেম্বর বাড়ি থেকে বের হন। দুদিন পর তাকে নিখোঁজের খবর দিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে ওসমানী নগর থানায় একটি জিডি করা হয়।

সাইফুল কওমি মাদ্রাসায় ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা করে ওসমানী নগর থানার দয়ামীর এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে নৈশ প্রহরীর চাকরি নিয়েছিলেন। সেখানে স্থানীয় এক মাওলানার কাছে সাইফুল উগ্রবাদের দীক্ষা নেন ও ‘হিজরতের’ সিদ্ধান্ত নেন বলে পুলিশের ভাষ্য।

‘ওই মাওলানা সাইফুল এবং আরও দুজন গত বছরের ১৫ নভেম্বর ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে শেরপুর গোল চত্বরে মিলিত হয়। এরপর সিলেট থেকে আরও চারজনসহ মাইক্রোবাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। পথিমধ্যে গাড়িতে থাকা এজেন্ট (নিয়োগকারী) তাদের দাড়ি কেটে দেয়, মোবাইল, এনআইডি, মানি ব্যাগ ও টাকা নিয়ে নেয়। তারা ঢাকার ফকিরাপুলে এসে বান্দরবানের বাসে ওঠে। বান্দরবন পৌঁছে তারা দেখতে পায় একই বাসে তাদের মত আরও ১০ জন ‘হিজরতকারী’ আছে। তাদের সবাইকে ভুয়া এনআইডি ও নাম দিয়ে প্রথমে থানচি নেওয়া হয়। পরে ১২ ঘণ্টা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটিয়ে ‘কেটিসি নামের’ বম পার্টির (কেএনএফ) একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।’

একই ক্যাম্পে মিলিত হওয়া
গ্রেফতার আরেকজন নাঈম হোসেন শেরেবাংলা নগরের এটিআইতে কৃষি ডিপ্লোমার চতুর্থ সেমিস্টারে পড়ড়েন। থাকতেন এটিআইর হোস্টেলে। গত বছরের ২ অক্টোবর কাউকে কিছু না বলে হল ছাড়েন তিনি। পরদিন তার পরিবার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডি করে।

সিটিটিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহামারীর কারণে কলেজ বন্ধ হলে গত বছরের প্রথম দিকে নাঈম তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে চলে যান। কুরআন শরিফ শুদ্ধ করে পড়া শিখতে সেখানে একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন তিনি। ওই মাদ্রাসার এক হুজুরের মাধ্যমে তিনি উগ্রবাদে দীক্ষিত হন এবং জঙ্গি সংগঠনে নাম লেখান। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা ফিরে এলেও জঙ্গিদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখছিলেন।
গত বছরের ২ অক্টোবর সকালে হল ছাড়ার পর কুমিল্লায় তার ‘নিয়োগকারীর’ কাছে নাঈম গিয়েছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য।

‘সেখানে বিভিন্ন সেফ হাউজে একমাসের বেশি সময় অবস্থান করে। নভেম্বরের ৮ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে সেসহ আরও প্রায় ১২-১৩ জন কুমিল্লা থেকে বান্দরবানের বাসে উঠে। বান্দরবান নেমে তারা চান্দের গাড়ি করে প্রথমে থানচি পৌঁছে। সেখানে বমপার্টির সদস্যরা তাদের রিসিভ করে। থানচি থেকে প্রায় ২ ঘণ্টা চাঁন্দের গাড়িতে গিয়ে তারপর প্রায় ১০ ঘন্টা হেঁটে কেটিসি ক্যাস্পে পৌছে। তারা এই ক্যাম্পের দ্বিতীয় হিজরতকারী দল।”
সিটিটিসির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বম পার্টির আশ্রয়ে প্রায় এক বছর জঙ্গিরা নিরুপদ্রবভাবেই ছিল। এ বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কেএনএফ তাদের জানায় যে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে পারে। ১০ অক্টোবর রাতে কেএনএফ কমান্ডার এসে তখনই তাদের ক্যাম্প ছেড়ে যেতে বলে। তারা তড়িঘড়ি করে ক্যাম্প ছেড়ে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে একটি জঙ্গলে অবস্থান নেন। প্রায় খাবার ও পানীয়হীন অবস্থায় এভাবে দুদিন চলে গেলেও কেএনএফ সদস্যরা ফেরত না এলে তারা বাধ্য হয়ে আবার সিপ্পি ক্যাম্পে (আরেকটি ক্যাম্প) যান। সেখানে সে রাতেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান শুরু করলে তারা ২১ ও ৩২ জনের দুই দলে ভাগ হয়ে যান। ২১ জনের দলটি ক্যাস্পে অবস্থান নিয়ে করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন। ৩২ জনের দলটি একটি জঙ্গলে অবস্থান নেয়, সেই দলেই সাইফুল ও নাঈম ছিলেন। পরে তারা হাঁটতে হাঁটতে ১৬ অক্টোবর তারপং খালে পৌছায়। সেখানে তারা আবারও আক্রমণের শিকার হয়। সে আক্রমণে তুহিন ও নাঈমসহ আরও একজন দলছুট হয়ে পড়েন এবং সমতলের উদ্দেশে হাঁটতে হাঁটতে তিন দিন হাটার পর তারা একটি মারমা পাড়ায় এসে উপস্থিত হন। মারমারা তাদের বম পাড়ায় পাঠালে বমরা তাদের তিনজনকে আবার কেএনএফের হাতে তুলে দেয়। কেএনএফ সদস্যদের সঙ্গে তারা জঙ্গলে এক মাসের বেশি সময় অবস্থান করে।

বিদ্রোহের শাস্তি নির্যাতন
গ্রেফতার তুহিন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সিলেট থেকে যাওয়া চারজন সেখানে থেকে চলে আসতে চাইলে তাদের টানা কয়েকদিন গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়, এক বেলা খাবার দেওয়া হয়। এরপর তাদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করা হয়, তাতে বলা হয়, ২০২৩ সাল পর্যন্ত থাকতে হবে। এসময় তারা আলাদা থাকবে, নিজেরা রান্না করে খাবে, কারও সঙ্গে কথা বলবে না এমন সব শর্ত দেওয়া হয়। একদিন এই চারজন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যান এবং বমদের হাতে ধরা পড়েন। তখন তাদের উপর নেমে আসে অমানুষিক অত্যাচার।

সিটিটিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাদের ১০০/৬০/৫০টি করে দোররা মারা হত। তাদের সঙ্গে দাস-দাসীদের মতো আচরণ করা হত। সবার কাপড় ধোয়া, লাকড়ি কাটা, সীমিত ভাত-পানি দেওয়া এবং কাজ শেষে আবার হাত পা বেঁধে ফেলে রাখা ছিল সেই শাস্তির ধরন, যা প্রায় তিন মাস পর্যন্ত চলেছিল।

সাইফুল ও নাঈম পুলিশকে বলেছেন, বম পার্টি কেটিসি ক্যাম্পে তারা প্রায় ৪ মাসের মতো ছিলেন। প্রথম ৩০ দিন তাদের ১২ জনকে কেএনএফ সদস্যরা পাশের পাহাড়ে ট্রেনিং করায়। সে সময় তাদের পিটি-প্যারেড, ক্যাম্প পাহারা, রসদ সংগ্রহ, ঘর তৈরি ও রান্না-বান্নার কাজ করতে হত। এ সময় আরও কিছু ‘হিজরতকারী’ সেখানে পৌছায়। একমাস পর তাদের পিটি প্যারেডের সঙ্গে রাতের বেলায় পাহাড়ে হাঁটার অনুশীলন করানেআ হয় প্রায় আরও একমাস। তারপর আরও মাসখানেক তাদের ডামি অস্ত্র এবং শেষে এয়ারগান ও বন্দুক দিয়ে অনুশীলন করায়।

‘জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার দুজন জানায়, তারা সেখানে যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারে মুলত শামীম মাহফুজ ওরফে স্যার এই দলটির মূল নেতা। তার পরিকল্পনা অনুসারেই ক্যাম্পের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হত। ক্যাম্পে আমির ওরফে আনিসুর ওরফে মাহমুদ, তমাল, রাকিব, ডাক্তার ভাই ওরফে ডা. শাকের, ক্যাম্প কমান্ডার কারসে ওরফে শিব্বির সবাই স্যারের পরামর্শ নিয়েই কাজ করত।’

শামীম মাহফুজ আলাদা ঘরে থাকতেন এবং তার ঘরের সামনে সশস্ত্র পাহারাদার থাকত বলে সাইফুল ও নাঈম পুলিশকে জানিয়েছেন।

‘কেএনএফ নেতা নাথান বম ক্যাম্পে এলে শুধু তার সাথেই দেখা করত ও কথা বলতো। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে একদিন নামাজের পরে শামিম মাহফুজ এবং আমির দলের নাম ঘোষণা দেয়, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রশিক্ষণের কয়েক দিন পর তারা জানতে পারে যে তারা ভারতের মিজোরাম ‘হিজরত’ করবে। সেখানেই তাদের ট্রেইনিং হবে।

‘সে মতে তারা সব কিছু গুটিয়ে তাদের ৫৫ জন এবং কেএনএফের প্রায় ২০০ জন মিজোরামের উদ্দেশে রওনা হয়। টানা ৫-৬ দিন হেঁটে তারা মিজোরাম সীমান্তে পৌঁছে সপ্তাহ খানেক জঙ্গলে অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত ঢুকতে না পেরে তারা আবার হেঁটে একটি পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে, এর নাম দেয় রেতেলাং ক্যাম্প।’

এই ক্যাম্পে প্রায় দুই মাস অবস্থানের পর হঠাৎ একদিন আরেকটি পাহাড়ি দল জেএসএস ওই শিবিরে হামলা চালায়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘তখন ব্যাপক গোলাগুলি হয় এবং তাতে ডা. আহমদ নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পরদিন জানাজা শেষে শামীম মাহফুজ এই ক্যাম্পের নাম দেয় শহিদ ডা. আহমেদ ক্যাম্প। পরবর্তীতে ওই ক্যাম্প ছেড়ে তারা সিপ্পি নামের পাহাড়ে নতুন করে ক্যাম্প তৈরি করে। এর নাম রাখা হয় ‘সিপ্পি ক্যাম্প’। শামিন মাহফুজ ও আমির এ ক্যাম্পে কিছুদিন থাকার পর সমতলে চলে আসে। সেখানেই তারা এ বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অবস্থান করে।’

সিটিটিসি জানিয়েছে, তারা চলে আসার পর এরপর গত ২৫ নভেম্বর তুহিন, নাঈমসহ তিনজন সমতলে পৌঁছান। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় সিটিটিসি খবর পেয়ে যায় এবং তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় তুহিন ও নাঈমকে গ্রেফতার করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশব্যাপী ২০২১ সাল থেকে ৭০ থেকে ৮০ জনকে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ তাদের সংগঠনে যুক্ত করেছে। পাহাড়ে তাদের আস্তানা গাঁড়ার উদ্দেশ্যে ছিল সেখানে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি এবং প্রশিক্ষণ নেওয়া। সেখান থেকে নেমে এসে নাশকতা চালিয়ে আবার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া