পাহাড়ি বসতি এলাকায় রাতে বাঙালিদের পাহারা

বন্ধ দোকানপাট-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান । শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে তদন্ত কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি »

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ছাত্রদের হাতে গণপিটুনিতে কারিগরি স্কুলের শিক্ষক সোহেল রানা হত্যাকা-ের ঘটনায় গঠিত চার সদস্যদের তদন্ত কমিটি গতকাল বুধবার ঘটনা সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে সদস্যরা এ সময় ছিলেন। এরই মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় সপ্তম শ্রেণির পাহাড়ি শিক্ষার্থীর পরিবার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধাদানের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত বহাল রাখা আছে ১৪৪ ধারাও। এখন পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় কেউ বাদি হয়ে কোন মামলা দায়ের করেনি। বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি বাজার ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবার রাতের গভীর সময় পর্যন্ত বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রামে আতঙ্কিত পাহাড়ি মানুষদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে বাঙালি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের।

সরেজমিন রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত নিজের বসতির মিশ্র এলাকায় (পাহাড়ি-বাঙালি) নেতৃস্থানীয় বাঙালি নেতা ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর মো. আব্দুল মজিদ, জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রব রাজা এবং সমাজকর্মী আব্দুল জলিলকে ত্রিপুরা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দায়িত্ব নিয়ে পাহারায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।

বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বেশিরভাগ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরো শহরের পাহাড়ি প্রধান এলাকাগুলোতে প্রায় শতভাগ দোকানপাটই খোলা হয়নি। এমনকি এসব এলাকায় বাঙালি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। পরিস্থিতি এমনই ছিল, খাবারের দোকান থেকে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। বিশেষ করে পরিষেবা দানকারী বেসরকারি হাসপাতাল, কুরিয়ার সার্ভিস এবং পরিবহন প্রতিষ্ঠানের কাউন্টার গুলোতে ছিল সুনসান নীরবতা।

খাগড়াছড়ি শহর থেকে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকা, রাঙামাটি যাবার একমাত্র টার্মিনাল খাগড়াছড়ি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। দুপুর ১টা পর্যন্ত যাত্রীশূন্য ছিল এই জনবহুল এলাকা।

হামলা কবলিত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে দেখা গেছে, জনমানবহীন ভুতুড়ে পরিবেশ। তাদের অভিযোগ; হামলায় নেতৃত্বদানকারীরা মাথায় হেলমেট এবং মুখে মাস্কপরা থাকলেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িতরা সবাই ছিলো মুখ খোলা এবং অপরিচিত।

খাগড়াছড়ি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মজুমদার মনে করেন, দেশের নানা জেলার নানা অঞ্চলের নানা ভাষাভাষী ও নানা ধর্মের বসতির শহর খাগড়াছড়ি। এটি এক মিশ্র ও বহু সংস্কৃতির শহর, কসমোপলিটন সিটি। এখানে যদি প্রতিবেশী হিসেবে নিজের এলাকাকে সম্প্রীতিময় রাখা যায়, সেটাই হবে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কল্যাণকর  দিক।

পৌর কাউন্সিলর এবং মহাজনপাড়ার এলাকার বিশিষ্টজন বাচ্চুমনি চাকমা জানান, ১৯৮৬ সালে মহাজনপাড়ায় ভাড়াটিয়া বহিরাগতদের দিয়ে যেভাবে অ্যাটাক হয়েছিলো; এবারও তেমনটাই ঘটেছে।

সমাজকর্মী নোবেল চাকমা জানান, পরিচিত মানুষ না হলেও তারা দেখে দেখে পাহাড়িদের সহায়-সম্পত্তিতেই হামলা করেছে। তার মানে এটা সুপরিকল্পিত।

খাগড়াছড়ি জেলার ‘সুজন’র সভাপতি অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সংঘটিত প্রতিটি অপরাধকে আইনের দৃষ্টিতে দেখে ন্যূনতম বিচার হওয়া উচিত। কোন অপরাধের সাম্প্রদায়িকীকরণ করার মানেই হলো কেউ না কেউ অপরাধের রাজনৈতিক বা অন্য উদ্দেশ্য হাসিলের পাঁয়তারা করছেন। স্বার্থান্বেষীদের শনাক্ত করা গেলে সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিরা স্বস্তি পাবেন।

বুধবার সকালে পুরো শহর ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে খাবারের হোটেল, পরিবহন এবং আবাসিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সবখানেই চরম স্থবিরতা বিরাজ করছে।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এস অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা জানান, অপ্রীতিকর ও অশান্ত পরিবেশের কারণে গত দুই সপ্তাহ ধরেই সবকটি আবাসিক ও খাবারের হোটেল, পরিবহন এজেন্সির সাথে সংশ্লিষ্টরা একেবারেই কর্মহীন।

খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ সাবের জানান, গণপিটুনিতে শিক্ষকের মরদেহের পোস্টমর্টেম শেষ হয়েছে। স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।