দীপক বড়ুয়া »
এই পার্কের সৌন্দর্যটা অন্যরকম।
বিশাল জায়গাজুড়ে এটার অবস্থান। বেশকিছু জায়গা সমতল।জুঁই চামেলি বেলি ফুলের সারি। কিছু পরে সারবন্দী দেবদারু গাছ। ঠিক মাঝখানে অভিনব লেক। লেকে রঙিন বোট আছে, নিজে।চালাতে পারে। আবার কিছু বোট আছে ইঞ্জিনের। ওগুলোতে চড়ে অনেকদূর যাওয়া যায়। সাপের মত আঁকাবাঁকা পাহাড় কোলে অনিন্দ্য লেকে। প্রকৃতির সবুজ গাছগাছালির বৈচিত্র্যে গড়া লেকের দুপাড়ের পাহাড়। লেকের স্বচ্ছ নীলাভ জল যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আবার অনেক জায়গা সমতল নয়। উঁচুতে নিজের ইচ্ছেয় গড়ে উঠেছে। বেশ সুন্দর পাকায় তৈরি বসার ব্যবস্থা আছে সারা পার্কে।
এই উঁচু জায়গাটা নিরিবিলি। সারিসারি তাল সুপারিগাছ। চাঁপা গাদা সূর্যমুখি রক্তজবা আরও কত ধরনের ফুলগাছের সমারোহ। এখানে ওঠা যায় সহজে। তবু কেন জানি এই জায়গাটা একা, সুনসান। এই উঁচু জায়গা বসে সিঁদুরমাখা সূর্যকে পশ্চিমে ডুব দিতে দেখা যায়। কী অসাধারণ মুহূর্ত তখন।
এই উঁচু জায়গাটাও অনেক বড়োসড়ো। অনেকগুলো বসার সুবিধা আছে। তবু এখানে কারো আসা-যাওয়া কম। তবে প্রতিদিন এক যুবক এখানে বসে পার্কের রূপ দেখে। ভাবে অনেককিছু। এই পার্ক কি সত্যিসত্যি মানুষের তৈরি,নাকি প্রকৃতির প্রেমের সৃষ্টি । চতুর্দিকে শুধু সবুজের মৌ মৌ গন্ধ। সঙ্গে ফুলের মিষ্টি গন্ধের আাহাজারি। একদিন এক মেয়েও আসে। সুন্দরী। উজ্বল শ্যামলা, কোমড় কোলে মৃদু হাওয়ায় খোলা চুলের নাচন। টানাটানা চোখ, কাজল মাখা। স্মার্ট। লম্বা সরু হাতজোড়া। পরনে পাতা রঙের ফ্রিন্টের জামা। গলায় পেঁচানো ওড়না, ওই সবুজ রঙের। যুবকের পাশাপাশি খানিক দূরের বেঞ্চে বসে যুবক ছেলেটাকে দেখে। ছেলেটির চোখ অনেকদূরে। ছেলেটি উজ্বল ফর্সা। শাদা শার্ট শাদা প্যান্ট পরা। পাশ থেকে যতটুকু দেখে বোঝা যায় ছেলেটিও ভারী মিষ্টি, স্মার্ট। দূরে কী দেখছে সে। মেয়েটি ভাবে। পার্কের রূপ নাকি লেকের নীলাভ স্বচ্ছ জল, না কি সারবন্দী রূপ-লাবণ্যে ভরপুর পুরো পার্কের শরীর।
একসময় বিকেল গড়ায়, সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে। দূরের সূর্য ডোবার প্রস্তুতি নেয়।পশ্চিম আকাশ সিঁদুর রঙে ভরে যায়। ছেলেটির চোখ সেখানে থইথই করে, নাকি সন্ধ্যা নামার সুদৃশ্য ছবিতে। সন্ধ্যা হয় হয় তখন। ছেলেটি দাঁড়ায়। মেয়েটির দিকে চোখ নেই। ঘাঢ় ফিরিয়ে হাঁটে। মেয়েটিও হাঁটে।
এভাবে দিন গড়ায়।
প্রতিদিন ওই ছেলে আর মেয়েটি পার্কে যায়। যেন এটা নিয়ম ওদের। ঠিক জায়গায় ওরা বসে। মেয়েটি কৌতূহল চোখে ছেলেটিকে দেখে প্রতিদিন। মেয়েটি ভাবে, ছেলেটি কি আদৌ মেয়েটিকে দেখে! এ শুধু স্বপ্নেই রয়ে যায়।
অনেকদিন পরে মেয়েটি সাহসী হয়ে ছেলেটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কথা বলবে কীভাবে। তবুও ছোট্ট করে বলে, আপনাকে প্রতিদিন এখানে বসে ভাবতে দেখি। কী ভাবেন?
ছেলেটি চুপ। একবারের জন্য হলেও একটু চোখ রাখেনি মেয়েটির দিকে। মেয়েটির রাগ হয়, ভাবে, ভারী অহংকারীতো ছেলেটি। আবারও ভাবে, ছেলেরা ওই রকম ভাবগম্ভীর না হলে মানায় না। প্রকৃত পুরষ মনে হয় না।
মেয়েটি দ্বিতীয় বারও বলে, কী ভাবছেন?
ছেলেটি এবার ঘাড় ফিরিয়ে বলে, আমাকে বলছেন? মেয়েটিও কম নয়, চারপাশ চোখ ঘুরিয়ে বলে,এখানে আমি আপনি ছাড়া আর কেউতো নেই। তাই প্রশ্নটা আপনাকে করেছি।
ছেলেটি বাম হাতের কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে বলে, আমার তাড়া আছে, যাচ্ছি।
সূর্য ডোবা দেখবেন না। প্রতিদিন দেখেনতো! মেয়েটির আচমকা প্রশ্ন।
আমি প্রতিদিন সূর্য ডোবা দেখি,এটা ভাববার কারণ আছে?
ছেলেটির ফিরতি প্রশ্ন।
কথা না বাড়িয়ে ছেলেটি ছোটছোট পা ফেলে চলে যায়।
মেয়েটি অসহায় চোখে ছেলেটির চলে যাওয়া দেখে।
একদিন এক বইয়ের দোকানে ছেলেটি অনেক ধরনের বই কিনছিল। ভাগ্যক্রমে মেয়েটিও বই কিনতে ওই দোকানে। ছেলেটির সাথে দেখা। একসঙ্গে অতগুলো বই কিনতে দেখে মেয়েটি প্রশ্ন করে, এত বই কি জন্য নিচ্ছেন? ছেলেটির সোজা উত্তর, আশ্রমের ছাত্রদের উপহার হিসেবে দেবো।
ভারি চমৎকার কাজতো! তা কোন আশ্রমের জন্য বলবেন?
প্রয়োজন নেই। বলে ছেলেটি একগাদা বই নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়।
কিছুদিন পরের কথা।
আবারও সেই পার্কে দুজনের দেখা। একই জায়গাতে। ছেলেটি কথা বলা পছন্দের নয়। মেয়েটির কৌতূহলের অন্ত নেই। ছেলেটি ঠিক একই বেঞ্চে বসে দূরে কী যেন দেখছে।মেয়েটি পেছনে দাঁড়িয়ে। একটু সময় অপচয় করে বলে,
আপনার নামটা কী বলবেন? আমি শরমিন আকতার।
ছেলেটির মুখে কথা নেই। চোখেমুখে বিরক্তিকর ভাব। মনে মনে বলে কী বেহায়া মেয়ে।! জানাশোনা নেই, তবু কথা বলার এত আগ্রহ কেন? তখনই সূর্য ডোবার সময়। আকাশে মেঘ জমেছে, টুকরো টুকরো। দখিন ছেড়ে উত্তরে ছুটছে।কী অদ্ভুত মেঘের টুকরোগুলো। নিমিষেই কাল রূপ ধারণ করে টুবটুব পড়বে যেন। শরমিন বলে, ওই দেখেছেন মেঘভর্তি আকাশ। এক্ষুণি বৃষ্টি পড়বে।
ছেলেটি বলে,আমার জরুরি কাজ আছে যাচ্ছি। ছেলেটি চলে যায় দ্রুত গতিতে।
শরমিন ছেলেটির দ্রুত চলে যাওয়ার ছবি দেখে কিংকর্তব্য বিমূঢ়। ভাবে কী অমন জরুরি কাজ নাকি আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ছেলেটি।
পরেরদিনও ছেলেটি একই বেঞ্চে বসে আছে। শরমিনের যেতে খানিকটা দেরি হয়। শরমিনের দূর্বলতা বেড়ে যায় ছেলেটার ওপর। কিছুতেই ছাড় নয় আর। ছেলেটার নাম, কী করে সে জানতেই হবে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ শরমিন।
শরমিনের মনে আরও একটি প্রশ্ন দানা বাঁধে। কেন কী কারণে প্রতিদিন ছেলেটির এই পার্কে আসা। কেউ কী প্রতিদিন পার্কে আসে? হয়তো অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে, শরমিন তুমিও আসো। কারণ কী বলবে?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই বলব, আমি আসি ছেলেটির আসার কারণ জানার আগ্রহে।
ছেলেটি নির্বিঘ্নে বসে দূরের প্রকৃতির বৈভব সৌন্দর্য দেখছে। আজকাল শারমিনের ভয় হয় না ছেলেটির কাছাকাছি যেতে। কয়েকবার তো কথা হয়েছে, ভয় কী?
ছেলেটি এবার উঠে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে। শরমিনের কথা হয় না আর। শরমিনও ছাড়ার মেয়ে নয়। ছেলেটির পিছুপিছু হাঁটে। আজ ছাড় নয়, ছেলেটি কোথায় থাকে, কী করে জানাতেই হবে। ছেলেটি মেইন রোড থেকে রিকশায় ওঠে। শরমিন দেরি করে না। পরের রিকশায় উঠে বলে,
-ভাইয়া, সামনের রিকশার পেছনে পেছন যাবে।
ছেলেটির রিকশাটা স্থানীয় একটি গীর্জার সামনে দাঁড়ায়। পেছনে শরমিনের রিকশা। ছেলেটি দ্রুত রিকশা থেকে নেমে গীর্জার ভেতরে চলে যায়।
শরমিনও গীর্জায় ঢোকে। সারিসারি চেয়ার ভর্তি মানুষে পূর্ণ প্রার্থনা হল।একটু পরে দেখে সেই ছেলেটি পাদ্রীর পোষাক পরে প্রার্থনা পরিচালনা করছে। ছেলেটি খ্রীষ্টান ধর্মীয় যাজক,পাদ্রী?
প্রার্থনার ফাঁকে শরমিনের দু’চোখ গড়িয়ে তপ্ত নোনা জল পড়ে। জল রুমালে মুছতে চায় বারবার। এ জল থামবার নয় কিছুতেই। জল পড়ছে অবিরাম। মনে মনে বলে, ছেলেটি খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় যাজক?
তার পরেরদিন।
ছেলেটি সেই বেঞ্চে বসে। শরমিন পেছনে নয়, এবার পাশাপাশি বসে দৃঢ় প্রত্যয়ে। সহজ প্রশ্ন করে, আপনি খ্রীষ্টান ধর্মীয় যাজক? একজন নিখাদ খ্রীষ্টান, আর আমি মুসলিম। জানেন, মানুষের জীবনটা খুব বড়ো নয়, ছোট। এই ছোট্ট জীবনে আমি মারাত্মক একটি ভুল করেছি। এই ভুল শোধাবার নয়।
কী ভুল করেছেন? ছেলেটি এবার সহজে প্রশ্ন করে শরমিনকে।
জীবনে কোনদিনই কাউকেই ভালোবাসিনি। শুধু আপনার ব্যক্তিত্বকে দেখে শ্রদ্ধাভরে আপনাকে ভালোবেসে ছিলাম। জানেন, আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি আপনাকে। কিন্তু-!
কিন্তু কী শরমিন?
– আপনি খীর্ষ্টান, আমি মুসলিম। দু’জন ভিন্নধর্মী। শত ভালোবাসা জমলেও মিলবার সুযোগ নেই। আচ্ছা আপনি কি কোনদিনও আমাকে পাশ থেকে দেখেছেন? আমি প্রতিদিন দেখতাম আপনাকে।
ছেলেটির মুখে মৃদু হাসির ঝিলিক ঝরে। ছোট্ট স্বরে বলে, আপনাকেও দেখতাম, আড়চোখে।
– কোনদিন কি আমার প্রতি ভালোবাসা জমেনি আপনার?
ছেলেটি আবারও চুপ। শরমিন আবারও প্রশ্ন করে,
-ভালোবাসা জন্মেছিল? থাক সে কথা। আপনার নামটা কী বলবেন?
ছেলেটি দ্রুত গতিতে চলে যায়।
শরমিন বেঞ্চে বসে সেই পাদ্রীর চলে যাওয়ার ছবি দেখে।
এবং অঝোরে চোখের জল ফেলে।