দীপক বড়ুয়া »
ঐ আকাশের শেষ সীমানা ছুঁতে চাও, পারবে না। আমার মতো।
মানে!
আমিও তাই। আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু অন্যদেশে। আমাকে কাছে পায় না কেউ। বলে কংকনা।
কি বলছ?
ঠিকই বলছি অনুরাগ।
বুঝলাম না। ওল্টো প্রশ্ন করে অনুরাগ।
দুজনের কত মিল। সেই কবে থেকে পরিচয়, কথা, ঘনিষ্ঠতা। যেকোনো সিদ্ধান্ত না মেলা পর্যন্ত এগোয় না। যেমন কংকনার পছন্দ নয় সেলোয়ার-কামিজপরা। শাড়িতে পূর্ণ বাঙালি মনে হয়। তাই কংকনা অনুরাগের কথায় শাড়ি পরে। দুই চোখে ফিরে দেখেনি সেলোয়ার-কামিজ।
একইভাবে কংকনারও অনুরাগের শার্টপেন্টপরা ভালো লাগে না। পছন্দ পায়জামা-পানজাবি। অনুরাগ একজন লেখক। প্রচুর লিখছে। লেখকের পানজাবিতে মানায়। ঋদ্ধবান মনে হয়। অতএব অনুরাগ পানজাবি পরতে অভ্যস্ত।
এভাবে জীবন চলে। কংকনার উত্তর।
আমার স্বভাব, চরিত্র বলতে পারো। কংকনা না থেমে বলে।
আমার কি হবে? তুমি ছাড়া আমি অচল। অনুরাগ রাগ মিশিয়ে বলে।
কি আর করি, নিজেকে বিসর্জন দিতে পারি না। কংকনার ছোট্ট উত্তর।
নীরবতা খেলে কিছুক্ষণ। অনুরাগ মাথার চুল টানে। অসহায়ভাবে নিজেকে। সাগরের দূরের ঢেউ দেখে। আচমকা প্রশ্ন করে, ঐ দূরের ঢেউ দেখেছ কংকনা, কত উঁচু, তীরে এসে মিশে যায় অনায়াসে।
কংকনা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে তখন। কথাটি কানে যায়নি।
একই কথা আবারও বলে অনুরাগ।
তাতে আমার কি? এটা ঢেউয়ের স্বাভাবিক নিয়ম।
মানুষের জীবন কি ঢেউয়ের মতো, বল।
কোনোদিন ভেবে দেখেনি।
আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছ?
কি ভাবব।
আমাদের বিয়ে।
না, বিয়ে নিয়ে ভাবিনি। কি হবে বিয়ে করে। কংকনার সাবলীল উত্তর।
ভাবোনি কেন? অনুরাগের রাগত প্রশ্ন।
বন্ধন এটা। নিজের স্বাধীনতা বলতে কি থাকে বল।
এখন কি পরাধীন তুমি।
হয়তো নয়। বিয়ে হলে পরাধীন হতে হবে নিশ্চয়ই। আমি মুক্তপাখির মতো হতে চাই। যখন ইচ্ছে দূরে যাব, ঘুরব, প্রকৃতির সাথে মিশে যাব। তখন সহ্য হবে তোমার।
আমাকে তোমার তাই মনে হয়।
মাকে কাছাকাছি দেখেছি। মায়ের গান গাইবার ইচ্ছে ছিল। মা’র গান শুনে বাবার সাথে কথা, পরিচয়, অতঃপর প্রেম, ভালোবাসা। পরপর বিয়ে। জানো, বিয়ের শেষে মাকে গান গাইতে দিত না বাবা। ফাংশনে মা গাইতে যেত। ফিরত গভীর রাতে। এটা বাবার সহ্য হতো না। বারণ করে শাসালো। বাবা-মা’র দূরত্ব বাড়ল। আমি অবহেলায় বড় হলাম। তারপরে বল, বিয়ে মানে মারাত্মক বন্ধন নয়। তুমি কি আমার স্বাধীনতা খর্ব করবে না।
আমাকে তোমার বাবার মতো ভাবছ কেন?
অনুরাগ, পৃথিবীর সকল পুরুষ এক। ভিন্নতা হয় না কোনোদিন। কোনো স্বামী চায় না তার স্ত্রী পরপুরুষের সাথে হাঁটুক, কথা বলুক। কথা বললে ওরা ভাবে, স্বামীর কাছ থেকে সে বুঝি দূরে চলে যাচ্ছে।
আমাদের ভালোবাসা, হৃদ্যতার দাম নেই।
নিশ্চয়ই থাকবে। যেমনটি আছ, থাকবে। আমিও থাকব কথা দিলাম।
বিয়ে?
কখনো না।
অনুরাগ কংকনার বাম হাত হাতে নেয়। সরু আঙুলে বিলি কাটে। কংকনা না করে না। এলোমেলো হাওয়ায় কংকনার লম্বা চুল অনুরাগের কপালে-নাকে খেলে। শ্যাম্পুমাখা চুলের গন্ধ ম ম করে। অনুরাগের মন বলে, কি মিষ্টি, এসব বিয়ে না হলে বঞ্চিত হব।
না, হয় না এটা। কংকনাকে বোঝাতে হবে।
কংকনা হাতে চুল সরিয়ে নেয়।
দূরে সাগর পারে যুবক-যুবতী জড়িয়ে ধরে। সেলফি তোলে।
অনুরাগ সেই মুগ্ধতাময় ছবির দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে, দেখ কংকনা, কী অপরূপ ছবি তুলছে ওরা। আমারও ইচ্ছে হয় সেলফি তুলি তোমার সাথে।
তোলো। তাতে লাভ কি?
স্মৃতিতে থাকল।
অনুরাগ ছবি তোলে, অনেক।
কংকনা বলে, ছবিগুলো কি করবে।
তুমি দূরে থাকলে দেখব। আপত্তি আছে?
কংকনা নির্বাক, চুপ।
ছোট্ট একটি ছেলে বাদাম নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। বলে, নেবেন স্যার। খুব ভালো। মজা পাবেন।
কংকনা খাবে।
খেতে ইচ্ছে হলে নাও।
তুমি খাবে না।
অসময়ে খাই না আমি।
পড়ন্ত বিকেল। সূর্যডোবার সময় হলো। বাদাম খেতে-খেতে সূর্যডোবা দেখব।
ইচ্ছে করছে না আমার।
জোয়ারের জল পা ছুঁইয়ে যায়। কংকনার ফরসা পা চকচক করে। হঠাৎ কংকনা বলে, চল হাঁটি। পা ডুবিয়ে হাঁটব আজ।
পা ডুবিয়ে হাঁটার সখ হল কেন?
শাসন করছ, বিয়ের আগেই। তাই বিয়েটিয়ে নিয়ে ভাবি না।
আশ্চর্য, দোষের কী হল। অতি সামান্য কথা।
ওরা হাঁটে। অনেকটা পথ হেঁটে থমকে দাঁড়ায় কংকনা। সাথে অনুরাগ।
ঐ দেখো সূর্য ডুবছে। সিঁদুর রঙে রঙ ছড়িয়ে। কংকনা মৃদু গলায় বলে।
ভারি সুন্দর। মায়া ঝরছে সূর্যের ঠোঁটে। অনুরাগের উত্তর।
তারপর অন্ধকার গিলে খাবে পৃথিবীকে। বার ঘণ্টা শেষে আবার সূর্য উঠবে পুবাকাশে। পৃথিবী ধবধবে আলোয় ভরবে। কংকনা বলে।
এটা সূর্য ওঠার নিয়ম।
জীবনের নিয়মও কি তাই। কংকনার অস্পষ্ট কথামালা। না থেমে বলে, মানুষের চলমান গতিপথ একই। আজ আছি, কাল নাই। তাহলে কিসের প্রয়োজন ঘনিষ্ঠতার। দূরাদূরি থাকলেই ভালো হয়।
অনুরাগ কংকনার গম্ভীর কথার অর্থ খুঁজে পায় না। ভাবে, তবে কি সে ভুল করল। কংকনার সাথে মেশা, কথা, কাছাকাছি, ঘনিষ্ঠতাÑÑ এসব।
কংকনাকে বলে, কি বলছ তুমি। না এটা হয় না কংকনা। তুমি আমার স্বপ্ন, আগামী দিন।
কংকনা থির দাঁড়িয়ে। চুপ।
অনুরাগ কংকনার হাত ধরে।
মৃদু ধাক্কায়।
পলকহীন চোখের সামনে হাত নাড়ায়।
নিশ্চুপ কংকনা।
অবাক চোখে কংকনার চারপাশ ঘুরে অনুরাগ। না-না কংকনা
এ রকম ছিল না তো।
এই কি সত্যি সত্যি একটু আগের কংকনা! বিশ্বাস হয় না অনুরাগের।
চোখে চোখ রাখে। পলকহীন চোখে আছে কংকনা।
না না কংকনা নয়, কংকনা যেন একটা পাথরপ্রতিমা।
রাটি নেই। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে! কী হবে এখন।
রাতের বয়স বাড়ছে ধীরে। মানুষের কোলাহল কমছে। দূরে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন থামে না।
অনুরাগ ডাকে, কংকনা বাড়ি চল।
পাথরপ্রতিমা কখনো কথা বলতে পারে? কংকনা পাথরমূর্তি। কথা বলার প্রশ্ন ওঠে না।
অনুরাগ কংকনার পাথরপ্রতিমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে একটি নতুন ভোরের প্রত্যাশায়।