পাঠ অথবা ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে একজন বদরুদ্দীন উমর

আহমদ জসিম »

বেশ কিছু দিন ধরে আমি বদরুদ্দীন উমর পাঠের মধ্যেই আছি, পাঠক মাত্রই তো জানেন, উন্নত সাহিত্য পাঠের মধ্যে থাকলে লেখক কতটা জীবন্ত হয়ে পাঠকের স্মৃতিতে ধরা দেয়, হোকনা সেটা সৃজনশীল অথবা মননশীল সাহিত্য। ব্যাপারটা যদি হয়, আত্মজীবনী তা হলে তো কথায় নেই, বদরুদ্দীন উমরের ৫ খণ্ডের আত্মজীবনী, ‘আমার জীবন” শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তির জীবনের গল্প নয়, বরং ইতিহাসের অনন্য দলিল। একটি জাতির বাঁক বদলের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার জন্ম, (১৯৩১) নীরোগ দীর্ঘ জীবন তিনি পেয়েছেন, এবং রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে এবং নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করছেন দেশ ভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনাকে, দেখেছেন স্বাধীনতা পরবর্তী ৫৪ বছরের বাংলাদেশকেও।
এই দেখাটাই হচ্ছে, বদরুদ্দীন উমরের লেখার রসদ, আমার ধারণা ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর লেখা, তিন খণ্ডের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ‘গবেষণা গ্রন্থটির আয়ুষ্কাল হবে বাঙালি জাতির সমান! এই মহান মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলন ৪টা আগস্ট, আমি যতদূর জানি উমর ভাইয়ের কোনো রোগ ছিলনা, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক এবং বয়সজনিত! তারপরেও কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের ভাষায় বললে বলতে হয, কিছু মৃত্যু থাকে হাঁসের ঝরা পালকের মতো হালকা, আর কিছু মৃত্যু থাকে পাথরের মতো ভারী, একজন বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যু আমাদের কাছে পাথরের মতো ভারী হয়ে দেখা দিয়েছে! এমন দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবন খুব কম মানুষেরই হয়।
তিনি একাধারে ছিলেন, রাজনৈতিক সংগঠক, প্রাবন্ধিক, গবেষক।এবং তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কর্মময় জীবন অতিক্রম করেছেন, এই মুহূর্তে তাঁকে নিয়ে আমার যে বিষয়টা খুব মনে পড়ছে, সেটা হলো উমর ভাইয়ের মৃত্যুর পনেরো দিন আগে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ভাষায়, ফেইসবুকে একটা পোস্ট দিতে হয়েছে! দিতে হয়েছে কারণ, তিনি এক লেখায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস তার ৯০ভাগেই হচ্ছে মিথ্যা”। ব্যাপারটা এই রকম নয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো এক মহান অর্জনকে এদেশের শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটা অংশ যে বিকৃত অথবা মুছে ফেলার প্রয়াস চালাচ্ছে, সেই সম্পর্কে আমরা অবহিত নই, আমরা জানি না যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের বাইরে কেউ নেই, আর ক্ষমতায় না থাকলে শেখ মুজিব বলেই কেউ নেই। এমন অদ্ভুতভাবে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সাজানোর প্রয়াস চালাচ্ছে শাসকগোষ্ঠী! কমরেড উমরের মন্তব্য নিয়ে আমাদের আপত্তির কারণ হলো, তিনি এমন এক সময় এই খণ্ডিত মন্তব্যটা করলেন, যখন সমাজের সর্বক্ষেত্রে ৭১ এর পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সংগঠিত হবার তৎপরতা চালাচ্ছে! তাঁর এই মন্তব্য আসলে সেই প্রতিক্রিয়াশীল অংশের হাতেই অস্ত্র তুলে দিল।
একজন বদরুদ্দীন উমরের ক্ষেত্রে কেন এমনটা হয়? যিনি আমৃত্যু এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।এটা কি বয়সের কারণে? বদরুদ্দীন উমরকে আমার কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা এবং শেষপর্যন্ত তাঁর লেখাগুলো নিবিষ্ট পাঠের অভিজ্ঞতার আলোকে জোর দিয়ে বলতে পারি, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি চিন্তায় খুব সক্রিয় ছিলেন, এবং মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতি বিভ্রমসহ যে নানা রকমের শারিরীক জটিলতা দেখা দেয়, তিনি তা থেকে ছিলেন অনেকটা মুক্ত। তিনি সম্ভবত শারীরিক সক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, উমর ভাই তাঁর আত্মজীবনীতে এক আত্মীয়ের কথা লিখেছেন, যার ১০১ বছর বয়সে একটা নতুন দাঁত গজিয়েছিল, এবং এই দাঁত গজানো উপলক্ষে গরু জবাই করে গ্রামবাসীকে খাওয়ানো হয়েছিল! এত কিছুর পরেও যে, আমরা তাঁর চিন্তার নানান বিভ্রান্তিগুলো দেখেছি, এটা মূলত তাঁর বিচ্ছিন্নতার ফল।
যে শ্রমিক -কৃষক, মেহনতি মানুষের জন্য তিনি আমৃত্যু রাজনীতি করেছেন, সেই বাঙালি শ্রমিক, কৃষক মেহনতিদের জীবন সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ রয়ে গেলেন, প্রথমত তিনি জন্ম নিয়েছেন অত্যন্ত অভিজাত পরিবারে, তাঁর পিতা আবুল হাসেম ছিলেন অবিভক্ত বাঙলার অত্যন্ত প্রভাবশালী এক মুসলিম নেতা, তাঁর নানা এবং দাদা ছিলেন সহোদর, চট্টগ্রামে যখন যুব বিদ্রোহ হচ্ছে, তখন চট্টগ্রামের জেলার জেলা প্রশাসক ছিলেন তাঁর বংশের একজন, নানা অথবা মামা হতে পারেন, তাঁর আত্মজীবনীতে পড়েছি, এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। তো, তিনি যে পরিবারে জন্মেছেন এবং যেভাবে বড় হয়েছেন, এটা অনেকটা সোনার চামুচ মুখে দিয়ে জন্মানোর মতো।
ব্যাপারগুলো তিনি একভাবে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে রাজনীতি করতে আসলেন তখন মাওলানা ভাসানী তাঁকে প্রস্তাব দিলেন কৃষক ফ্রন্টের দায়িত্ব নিতে, কমরেড উমর প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বললেন, দেশের কৃষক সম্পর্কে তাঁর ন্যূনতম ধারণা নেই, তাই তিনি কৃষক সংগঠনের কোনো দায়িত্ব নিতে পারবেন না। মাওলানা তারপর প্রস্তাব দিলেন ন্যাপের সম্পাদক হতে, কমরেড উমর স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতে এসেছেন, ন্যাপ নয়! শ্রেণী রাজনীতির প্রতি দৃঢ় অবস্থান সত্বেও,কমরেড উমরের শ্রেণির মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার ঘাটতি দীর্ঘ জীবনেও অনেকটা রয়ে গেছে বলে, আমাদের নানান সময়, মনে হয়েছে! তো, বদরুদ্দীন উমরের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, গত শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে, অথবা এই শতাব্দীর শুরুতে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি কখনো কমরেড উমরের পার্টি না করেও তাঁর দলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার তারুণ্যের প্রথম দিকেই। সেটা হতে পারে লেখক শিবিরকে কেন্দ্র করে এক রমরমা সাহিত্যে আড্ডার মোহে, অথবা কিছু বন্ধুর টানে। একসময় বাম চিন্তা নিয়ে যারা লিখতে আসতেন তাঁদের কাছে লেখক শিবির ছিল স্বপ্নের ঠিকানা।
আমি যখন লেখক শিবির চিনি, তখনো সংগঠনটার সাথে যুক্ত ছিলেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী আর শান্তনু কায়সারের মতো লেখকরা, চট্টগ্রামে ছিলেন, আসহাব উদ্দীন, ইয়াকুব আলী মোল্লা আর করিম আবদুল্লাহর মতো মানুষেরা, তার সাথে ছিলেন অসম্ভব আড্ডারু, বিদগ্ধ পাঠক ও তরুণ বুদ্ধিজীবী আমির আব্বাস তাপু। আড্ডা বসতো চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের অপজিটে গবি জোটের অফিসে, সেখানেই আমি বদরুদ্দীন উমরকে প্রথম দেখি এবং দীর্ঘ আলাপের সুযোগ হয়। তখনো সাকি ভাইরা কমরেড উমরের সাথেই ছিলেন, তবে দ্বন্দ্বটা শুরু হয়েছিল, কানাঘুষা ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সম্ভবত জুনায়েদ সাকির নেতৃত্বকে ছাত্র ফেডারেশন একটা অংশের সাথে উমর ভাইদের বিরোধটা দেখা দেয়, উচ্চ শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন প্রসঙ্গ ধরে। সেই প্রসঙ্গে আলাপচারিতার জন্যই উমর ভাই চট্টগ্রাম পার্টি অফিসে এসেছিলেন, চট্টগ্রাম গবি জোটের অফিসে যে সভা হয়েছিল তার সঞ্চালক ছিলেন, তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের নেতা, বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষিকা সুবর্ণা মজুমদার, আমি উমর ভাইয়ের পার্টির কর্মী সমর্থক না হয়েও সেই আলোচনায় আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল, সম্ভবত রুমি ভাই, তাপুদা কিংবা বন্ধু শিমুলের বদন্নতায়। সেদিনের উমর ভাই, উচ্চশিক্ষা ও শ্রেণী রাজনীতির যে আলাপ তুলেছিলেন সেটা আমাকে মোটেও তুষ্ট করতে পারেনি। তবে ফরমাল আলোচনা শেষে আলাদা করে উমর ভাইয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাপুদা, সেই আলাপের স্মৃতিটা প্রায় আড়াই দশক ধরে বহন করছি, আমার জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো মধুর স্মৃতি থাকলে এটাই তার অন্যতম!
আমাদের দেশের বড় মানুষদের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, তাঁর ক্লাসিক পড়ার পর আর কনটেম্পোরারি লিটারেচার পড়তে চান না, অথচ ব্যতিক্রম দেখলাম কমরেড উমরকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন তিনি আলাপটা শুরু করেছিলেন বেগম আখ্তারির গজল দিয়ে। তারপর বঙ্কিমের গদ্য,বিদ্যাসাগরের সমাজ চিন্তা থেকে শুরু করে শরৎ সাহিত্য, সিকান্দার আবু জাফর, শহীদ সাবের, আহসান হাবিব হয়ে, মঈনুল আহসান সাবেরে গিয়ে থামলেন, মঈনুল আহসান সাবেরের গল্প নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দু’চারটে মন্তব্য করলেন কমরেড উমর, তাঁর এই মন্তব্যের সূত্র ধরেই আমি সাবের পাঠে আগ্রহী হয়ে উঠলাম, এবং তার গল্প এবং উপন্যাস নিয়ে আলাদাভাবে লিখলাম দুইটা প্রবন্ধ। এরপরেও উমর ভাইয়ের সাথে আমার একাধিকবার দেখা হয়েছে, কথা বলার সুযোগও হয়েছে, তবে তাঁকে আমার কখনোই একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা বলে মনে হয়নি। তিনি বরং একজন আপোষহীন লড়াকু বুদ্ধিজীবী, যিনি কখনো নীতির প্রশ্নে আপোষ করেননি।
তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়ার পর খবরটা দেওয়ার জন্য তার পিতা আবুল হাসেমের কাছে যান, খবরটা শুনে আবুল হাসেম নাকি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “ আমার ইচ্ছে ছিল শেষ বয়সে, তোমার কাছেই থাকবো, চাকরিটা ছেড়ে তুমি এখন আমাকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিলে”। বস্তুতপক্ষে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে আপোষ না করে শিশু সন্তানসহ তাঁর পুরো পরিবারকেই এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেই ফেলে দিয়েছিলেন। এবং আমৃত্যু তিনি এইভাবেই অনিশ্চিত অথচ আপোষহীন জীবন কাটিয়েছেন। যে কারণে তাঁর সৃষ্টির ভাণ্ডারও হয়ে উঠেছে এদেশের সমাজ বিপ্লবের এক অনন্য সম্পদ। তাঁর গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গেলে লেনিন প্লেখানভ সম্পর্কে যে বলেছিলেন, “কেউ যদি বলে, আমি মার্কসবাদ বুঝি, অথচ প্লেখানভ পড়িনি, তার মার্কস বোঝা নিয়ে আমি সন্দেহ করি”। সেই একই কথার সাথে মিলিয়ে বলতে হয়, বাংলা ভাষায় মার্কসবাদ বুঝতে হলে, একজন মার্কসবাদী লেখক কমরেড বদরুদ্দীন উমরকে পাঠ করতেই হবে, কারণ তিনি তো আসলে এই বঙ্গের প্লেখানভ।

লেখক- সাহিত্যিক ও রাজনৈতিককর্মী