নিজস্ব প্রতিবেদক
কোরবানের ঈদ মাত্র কয়েকদিন বাকি। প্রতিবছর এ সময়ে হাটগুলোতে জমে উঠে পশুর বেচাকেনা। এবার পশুর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও ক্রেতা সংকটে কেনাবেচায় চলছে মন্দা।
উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার পশুর দাম কিছুটা বেশি বলে বিক্রেতারা জানালেও সীমান্ত দিয়ে দেশে গরু প্রবেশ করলে, বাজারে গরুর দাম কমে যাবে এবং এতে তাদের বড় লোকসানের পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। এ অবস্থায় পশু বিক্রি ও দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন খামারি, উৎপাদক ও পশু বিক্রেতারা।
গতকাল রোববার নগরীর সাগরিকা, কর্ণফুলী গরুর বাজার, বড়পোল সংলগ্ন গোডাউনের পরিত্যক্ত মাঠ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের আউটার রিং রোড সিডিএ বালুর মাঠের পশুরহাট গুলোতে সরেজমিনে দেখা যায়, হাটে গরুর সংখ্যা পর্যাপ্ত রয়েছে। পাশাপাশি দর্শনার্থীদেরও ভিড় বেড়েছে। কিন্তু সে হারে পশু বেচাকেনা তেমন চোখে পড়েনি। আশানুরূপ দামে বিক্রি করতে পারছে না বলে হতাশা প্রকাশ করেন স্থানীয় পশু বিক্রেতারা ।
তাছাড়া নগরীর স্থায়ী ও অস্থায়ী পশু হাটগুলোতে ইতোমধ্যেই ব্যাংকিং লেনদেনের ব্যবস্থা, পুলিশি নিরাপত্তা, অবকাঠামো তৈরি করে দেওয়াসহ বেশ নিরাপত্তা জোরদার করেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
হাট সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাত থেকে বিভিন্ন স্থানসহ সাতকানিয়া, পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, পেকুয়া থেকেও গরু বাজারে আসছে। কিন্তু সেই হিসেবে বেচাকেনা বেশ মন্দা। বিক্রেতারা তাদের পশুর দাম হাঁকালেও ক্রেতারা তেমনটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অনেক ক্রেতা মনে করছেন অন্যান্যবারের মত এবারো পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গরু আসবে। তখন কিছুটা সস্তায় পাওয়া যাবে। এতে পশুপালনের সাথে জড়িত খামারি ও বিক্রেতারা শঙ্কায় আছেন। পাশাপাশি বড় লোকসান হতে পারে ধারণা করছেন তারা।
পটিয়ার মালিয়ারা থেকে আউটার রিং রোড সিডিএ বালুর মাঠের পশুরহাটে আসা মো. জাহেদুল করিম বলেন, ‘এবার ১০টি গরু হাটে তুলেছি। যার মধ্যে গত দু’দিনে একটি গরু বিক্রি হয়েছে। ক্রেতারা যে দাম দিতে চায়, এতে গরু বিক্রি করা অসম্ভব। ক্রেতাদের দরে বিক্রি করলে আড়াই মণ ওজনের একটি গরুতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লোকসানে থাকবো।’
সন্দ্বীপ থেকে সাগরিকা বাজারে আসা মো. আরিফুল আলম বলেন, ‘পশু বিক্রির সাথে জড়িত ১০ বছর ধরে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর পশুপালনে খরচ বেড়েছে। স্থানীয় পশু বিক্রেতারা যদি একটু দাম না পায় তাহলে এতে আগ্রহ হারাবে। এর মধ্যে শুনছি বাজারে ভারতীয় গরু আসতে শুরু করছে। যদি তেমন হয় তাহলে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়তে হবে।’
একই বাজারে কুষ্টিয়ার থেকে আসা আরেক খামারি আলম বাবু বলেন, ‘সাতটি গরু নিয়ে চট্টগ্রামে এসেছি। এখনো একটা বিক্রি হয়নি। কোরবানের বাকি আছে মাঝখানে মাত্র তিনদিন। শুনছি, চোরাই পথে ভারতীয় গরু আসছে বাজারে। এ অবস্থা হলে, ভালো দাম পাবো কিনা চিন্তায় আছি।
কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে কর্ণফুলী গরুর বাজারে আসা মো. সেলিম বলেন, ‘পেকুয়ার বিভিন্ন এলাকা গরু কিনে শহরে বিক্রি করতে আসলাম। হিসেব করলে প্রতি গরুতে মণপ্রতি ২৮ হাজার টাকার বেশি পড়েছে। এখানে আনলাম একটু বেশি দাম পাওয়ার আশায়। একবছর আগে যে ভূষি কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যেত, তা গ্রামপর্যায়ে বিক্রি করছে ৮০ টাকার উপরে। তার মধ্যে সকল ধরনের ভেটেরিনারি ওষুধের দাম বাড়তি। পরিবহন খরচও বেড়েছে। এ অবস্থায় গরুর কেনা দর তুলতে পারবো কিনা চিন্তায় আছি।’
এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঈদুল আজহা সামনে রেখে গত ২২ জুন পর্যন্ত ৬৪৬টি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ৫১ হাজারেরও বেশি পশুর ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে ইতোমধ্যেই ৯ হাজারের বেশি পশু বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছর কোরবানির আগে ৭০ হাজার ৫৭০টি পশু বিক্রি হয় অনলাইন মাধ্যমে, যার মূল্য ছিল ৪৮০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর ৯৯ লাখ পশু সারাদেশে বিক্রি হয়েছিল। সেবার কোরবানি কম হওয়ার প্রধান কারণ ছিল করোনা পরবর্তী প্রভাব। কিন্তু অধিদপ্তর বলছে, এবারে চাহিদা আরো বাড়বে। সে হিসেবে দেশে ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজারের একটু বেশি পশুর চাহিদার হিসাব ধরা হয়েছে। এই চাহিদার বিপরীতে মোট গবাদিপশুর মজুদ ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি।
এবারের মজুদ পশুগুলোর মধ্যে দেশে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং ২ হাজার ৫৮১টি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে পশু রয়েছে ২০ লাখ ৫৩ হাজার। জেলা পর্যায়ে উৎপাদিত গবাদি মোট পশু ৮ লাখ ৪২ হাজার ১৬৫টি। তার মধ্যে গরু ৫ লাখ ২৬ হাজার ৩২৫টি, মহিষ ৭১ হাজার ৩৩৩টি, ছাগল ও ভেড়া ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪০৫টি এবং গয়াল, দুম্বাসহ অন্যান্য ১০২টি।
তাছাড়া অনান্য বিভাগের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮ লাখ ৯৫ হাজার; রাজশাহী বিভাগে ৪৫ লাখ ১১ হাজার; খুলনা বিভাগে ১৫ লাখ ১১ হাজার; বরিশাল বিভাগে ৪ লাখ ৯৩ হাজার; সিলেট বিভাগে ৪ লাখ ১০ হাজার; রংপুর বিভাগে ১৯ লাখ ৬২ হাজার এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৬ লাখ ৯৮ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘এবার চট্টগ্রামের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়ে আমাদের চাহিদা পূরণ হবে। তাছাড়া আশপাশের জেলাগুলো থেকেও প্রচুর গরু চট্টগ্রামে আসছে। আমাদের দেশীয় গরু কেনার এখন ক্রেতা নেই। অন্যদেশের গরুর উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে না।’
সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অবৈধভাবে গরু পাচারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, দেশে যেন কোনভাবে অন্য দেশের গরু না আসে। সেই বিষয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর জানানো হয়েছে। আমরা চায় যেন দেশের খামারি ও গরু পালকরা যেন তাদের ন্যায্য মূল্যটি পায়।’