আমজাদ আল মামুন »
আবিদের বয়স পঞ্চাশ। ঢাকার মোহাম্মদপুরে তার নিজের ফ্ল্যাট, অফিসের দেওয়া দুটি গাড়ি, স্ত্রী সিমি, কলেজগামী কন্যা ঝলমল, আর প্রাথমিক শ্রেণীতে পড়ুয়া পুত্র সৌম্য- সব মিলে যেন নিখুঁত মধ্যবিত্ত সুখের চিত্র।
প্রতিদিন সকালে অফিসের গাড়িতে বেরোনোর আগে সিমি দরজায় দাঁড়িয়ে বলত,
“আজকে বাজারে যেতে হবে মনে রেখো, ঝলমলের নোটবই শেষ।”
আবিদ জবাব দিত, “অফিস থেকে বেরোতেই মনে করিয়ে দিও, না হলে এই ট্রাফিকে সব ভুলে যাই।”
তারপর ব্যাগ হাতে নিতে নিতে সিমি আবার বলত, “এই মাসে ব্যাংকের কিস্তি দেবে তো?”
আবিদ হেসে উত্তর দিত, “ওটা না দিলে ফ্ল্যাটটাও আমাদের থাকবে না, চিন্তা করো না।”
বেরোবার ঠিক আগে আবার মনে করিয়ে দিত,
“আজ একটু দেরি করো না, ঝলমলের টিউশন আছে।”
আবিদ বলত, “চেষ্টা করব, ট্রাফিক যদি মাফ করে।”
তখনো কেউ জানত না, এই স্বাভাবিক সকালগুলোই একদিন স্মৃতির পরিযায়ী সময় হয়ে যাবে।
ভিসার চিঠি আসার দিনটা ছিল বর্ষার সকাল। জানালার ধারে চা হাতে দাঁড়িয়ে সিমি বলেছিল,
“আমরা কি সত্যিই চলে যাব?”
আবিদ চুপ করে কাগজটার দিকে তাকিয়েছিল, সাদা পাতার ওপর সরকারি সিলমোহরটা যেন কোনো নিয়তির ঘোষণা।
“যাওয়া মানে তো সব ফেলে যাওয়া,” সে বলেছিল।
“না,” সিমি বলেছিল ধীরে, “সব ফেলে যাওয়া নয়, ওদের জন্য একটু নতুন করে শুরু।”
ঝলমল আনন্দে বলেছিল, “আমেরিকায় স্নো পড়ে, তাই না মা?”
সৌম্য জিজ্ঞেস করেছিল, “সেখানে ক্রিকেট খেলে?”
তাদের চোখে ভবিষ্যতের রঙিন কুয়াশা, কিন্তু আবিদের মন ছিল কেবল ঢাকার কুয়াশা, যেখানে অফিসবাসের হর্ন, চায়ের দোকানের ধোঁয়া, সহকর্মীর হাসি, সব মিলিয়ে এক অন্যরকম উষ্ণতা ছিল।
বিদায়ের দিন আত্মীয়স্বজন ভিড় করেছিল। কেউ বলেছিল, “ভালো করছো, ওদের ভবিষ্যৎ তো ওখানেই।”
কেউ আবার ফিসফিস করে বলেছিল, “এই বয়সে আবার নতুন শুরু? কষ্ট হবে। তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বেঁচে কী সম্মান?”
আবিদ শুধু হেসেছিল, কিন্তু তার ভিতরে কেমন একটা হাহাকার যেন অচেনা কোনো পথে হাঁটতে যাচ্ছে, যেখানে নিজের ছায়াটাও চিনবে না সে।
ঢাকার সেই শেষ রাতের কথা তার এখনো মনে আছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের মিনারের আলো দেখছিল। মনে হচ্ছিল, শহরটা নিঃশব্দে তাকে বিদায় জানাচ্ছে।
আবিদ দেখেছিল ঢাকার আলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে, ঠিক যেমন নিভে যায় মোমবাতি, কিন্তু তার গন্ধটা থেকে যায় দীর্ঘক্ষণ।
আমেরিকায় পৌঁছানোমাত্রই সবকিছু যেন সিনেমার দৃশ্য চওড়া রাস্তা, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, দূর পর্যন্ত টানা আলোকরেখা। বাতাস ছিল স্বচ্ছ, কিন্তু তাতে কোনো গন্ধ নেই; মানুষের মুখে হাসি ছিল উজ্জ্বল, কিন্তু তাতে কোনো উষ্ণতা নেই। ছোট্ট এক অ্যাপার্টমেন্ট দু’টি বেডরুম। জানালার বাইরে সারি সারি গাছ, যাদের ডালপালা শীতের কামড়ে কঙ্কালসদৃশ। তবু তাদের নিঃস্তব্ধ দেহে যেন এক ধৈর্যের সৌন্দর্য যেন জীবন হারিয়েও টিকে থাকা এক প্রতিজ্ঞা।
আবিদ প্রথম রাতেই জানালার কাঁচে হাত ছুঁয়ে বলেছিল,
“এখানে কোনো শব্দ নেই, মনে হয় পৃথিবী ঘুমিয়ে গেছে।” সিমি বলেছিল, “শব্দ নেই, কিন্তু ভয়ও নেই।” স্কুলের প্রথম দিন ঝলমলের অসুবিধা না হলেও সৌম্যর হয়েছিল। সে কান্না করেছিল ভাষা বুঝতে না পারায়।
সৌম্য বইয়ে অচেনা অক্ষর দেখে বলেছিল, “এটা ইংরেজি না!” কিন্তু সিমি ধৈর্য ধরে বলেছিল, “শুরুতে কঠিনই লাগে, তারপর সব সহজ হয়ে যাবে।” প্রথম শীতের দিনগুলোয় তুষারের সৌন্দর্য যেন রূপকথা,
কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহে বরফের মধ্যে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আবিদ বুঝেছিল রূপকথারও শীত লাগে। দেশে সে ছিল কোম্পানির সিনিয়র লিডারশিপ টিমের সদস্য তার প্রেজেন্টেশনে সবাই তাকিয়ে থাকত। কিন্তু এখানে ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে সে যেন অপরিচিত এক ছাত্র প্রতিটি প্রশ্নই যেন নতুন পরীক্ষা।
একদিন রাতে সিমি জিজ্ঞেস করল,
“কী হলো আজ?”
আবিদ বলল, “বলল, আমার ডিগ্রি এখানকার সমমান নয়।”
“আবার চেষ্টা করো।”
“প্রতিদিন চেষ্টা করছি, কিন্তু এখানে ডিগ্রির চেয়ে বয়সটাই বেশি।”
সে ভাবল, দেশে সে যে মানুষ ছিল, এখানে সে কেবল এক রিজিউমি।
গ্যাস স্টেশনের কাজ নিতে বাধ্য হওয়ার দিন সে আয়নায় নিজেকে দেখে হেসে বলেছিল,
“মানুষকে কেবল তার বেতনেই মাপা যায় না, কিন্তু এখানে হয়তো যায়।”
দিনের শেষে তেলের দাগে ভরা ইউনিফর্ম আর নিঃস্তব্ধ নীরবতা নিয়ে ঘরে ফিরত সে। এদিকে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটি, দ্রুতই বুঝল তাঁরা সেখানে বেমানান। এক দল অতিরিক্ত ধর্মচর্চা, প্রতিটি আচারে ধর্মের পরিমাপ; অন্য দল অতি আধুনিক, আত্মকেন্দ্রিক পেশাজীবী। বুয়েট, ডিএমসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলভাগ সেখানেও টিকে আছে। ফলে আবিদ-সিমি কারও সঙ্গেই পুরোপুরি মিশে উঠতে পাওে না নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারনে।
একবার এক ঘরোয়া আড্ডায় কেউ বলেছিল,
“আমরা যারা সত্যিকারের মুসলমান, তারাই টিকে থাকব।” আবিদ শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিল, “টিকে থাকার জন্য ভালোবাসা দরকার, ধর্ম নয়।” মুহূর্তেই চারপাশে নীরবতা নেমে আসে। পরে বাসায় ফিরে সিমি বলেছিল, “তুমি এমন কথা বলো কেন? একটু চুপ থাকলে কি ক্ষতি?”
আবিদ জানালার বাইরে তাকিয়ে বলেছিল,
“চুপ থাকলে মানুষ একসময় নিজের ভিতরের শব্দটাই ভুলে যায়।”
তাই সে হয়ে উঠল এক অদ্ভুতঅভিবাসী যেন সমুদ্রের মাঝখানে ভেসে থাকা নোঙরবিহীন জাহাজ, যার সামনে দিগন্ত আছে, কিন্তু কোনো তীর নেই। এই শহর অট্টালিকার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচের জঙ্গল। দিনে সূর্যের আলোয় তা জ্বলে ওঠে আয়নার মতো, রাতে আকাশের তারা পর্যন্ত যেন লজ্জায় ম্লান হয়ে যায়। তবু এই বিশালতার ভেতরেও এক নিঃসঙ্গতা আছে যেন গোধূলির রঙে রঞ্জিত কোনো বিরাট ছবির মাঝখানে
এক ছোট্ট মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সিমি ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে লাগল। সুপারশপে গেলে দাম চেক করত, নতুন রেসিপি চেষ্টা করত, রাতে ইংরেজি অনুশীলন করত। তবু মাঝে মাঝে সে বলে উঠত, “ঢাকায় আমাদের ফ্ল্যাটটার বারান্দা মনে পড়ে রোদ পড়ত ঠিক বিকেল পাঁচটায়।” আবিদ মৃদু হেসে বলত, “এখানে রোদ পড়ে, কিন্তু উষ্ণতা পড়ে না।” একদিন ফোনে পুরোনো বান্ধবী বলল, “তুই তো এখন পুরোপুরি আমেরিকান।”
সিমি হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমার চায়ের কাপ এখনো ঢাকার মতোই ছোট।” ঝলমল দ্রুত বদলে গেল নতুন বন্ধু, নতুন উচ্চারণ। সিমি একদিন বলল, “তুমি এখন বাংলায় কম কথা বলো কেন?” ঝলমল বলল, “স্কুলে কেউ বুঝবে না, মা।” সিমি কষ্ট পেলেও কিছু বলেনি। সৌম্য স্কুল থেকে ফিরে বলল,
“আমার বন্ধুরা বলে, আমাদের দেশ নাকি গরিব।”
আবিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“গরিব দেশ মানে কি? যার মাটিতে ঘাস গজায়, যে দেশে মানুষ এখনো হাসেসে দেশ গরিব না।” দিন যায়, মাস যায়। আবিদ নিজের ভিতরে হারিয়ে যেতে থাকে। রাতে জানালার বাইরে বরফ পড়ে নীরব, অবিরাম।
সে ভাবে, এই বরফ ঢাকা শহরে কেউ জানে না,
তারও এক সময় ঘাম ছিল, ক্লান্তি ছিল, অর্জন ছিল। এখানে সবই মুছে গেছে তুষারের নিচে। কখনো কফি হাতে বসে ভাবে, “ঢাকায় এখন বিকেল হয়ে এলো, অফিসের ছুটির হর্ন বাজছে। বিজয় সরণির দুই ঘণ্টার ট্রাফিক জ্যামে গাড়ির পেছনের সিটে হেলান দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। গাড়ির স্টেরিওতে বাজছে অদিতি মহসিনের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘বিপুল তরঙ্গরে সব গগন উদ্বেলিয়া, মগন করি অতীত অনাগত আলোকে।’”
মনে হয়, সে যেন দুই সময়ের মাঝে ঝুলে আছে একটা গেছে, একটা এখনো আসেনি। একদিন বিকেলে গ্যাস স্টেশন থেকে ফেরার পথে পার্কে গিয়ে বসেছিল সে। বরফ গলে পানির ধারা বয়ে যাচ্ছে। পাশেই কয়েকটি পাখি দুটি কানাডা গিজ, এক জোড়া স্নো গুজ, আর এক ছোট্ট রবিন। আবিদ হঠাৎ তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা জানো, আমি-ও পরিযায়ী।” রবিনটা ডানা ঝাপটাল। সে বুঝল, এই পাখিগুলো তার মতোই, যারা উড়ে যায় উত্তর থেকে দক্ষিণে বা দক্ষিণ থেকে উত্তরে, কিন্তু কোথাও পুরোপুরি ঘর বানাতে পারে না। সেই রাতে বাড়ি ফিরে আবিদ টেবিলে একটি খাম রাখল। তার ভেতরে ছিল একটি কাগজ, বিমান টিকিটের প্রিন্টআউট, ঢাকা গামী। সিমি দেখে অবাক হয়ে বলল, “তুমি ঠিক করেছ? তুমি কী যাচ্ছো সত্যি?” আবিদ শান্ত স্বরে বলল, “হ্যাঁ। ভাবলাম কিছুদিন যাই পুরনো বাতাসে একটু শ্বাস নিই।” সিমির চোখে জল চিকচিক করে উঠল। “আমাদের কি পিছিয়ে যাওয়া এই সময়ে ঠিক?” আবিদ ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “না সিমি, এটা পিছিয়ে যাওয়া নয়, এটা ফিরে দেখা। যেমন গাছের পাতা পড়ে মাটিতে মিশে যায়। মাটি তো তাকে গিলে খায় না, বরং আবার জীবন দেয়।” সিমি চোখ মুছে হাসল।
“তুমি সব কথায় কবিতা খুঁজে পাও।”
আবিদ বলল, “কবিতা খুঁজে পাই, কারণ গদ্যে আমি হারিয়ে গেছি।”
কিছুক্ষণ নীরবতা। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বাজছে,
যেন সময় নিজেই তাদের সঙ্গে কথা বলছে,
‘থাকো’, ‘যাও’, ‘থাকো’, ‘যাও’ দুটি বিপরীত ডাক, দুটি দিক। ঝলমল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
“তুমি সত্যিই যাচ্ছো?”
আবিদ মৃদু হাসল, “হ্যাঁ মা, একটু নিজের দেশটাকে দেখতে চাই।” ঝলমল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তুমি জানো, আমি এখনো বাংলাদেশের পতাকা আঁকি ক্লাসে।
ওরা বলে তুমি কি দেশপ্রেমিক? আমি বলি না, আমি কৃতজ্ঞ। কারণ ওই দেশেই আমার বাবা জন্মেছেন।”
সৌম্য ছুটে এসে বলল, “বাবা, আমি জানি না দেশ কী,
কিন্তু তুমি যেখানেই থাকো, সেটাই আমার দেশ।”
আবিদ ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, “তুমি পাখি, তোমার আকাশ বড়। আমার শিকড় আছে আমি উড়তে পারি না।” বিমানবন্দরের পথে সিমি বলল, “তুমি গেলে এই ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাবে।”
আবিদ বলল, “ঘর ফাঁকা হয় না, যদি ভালোবাসা থাকে।” সৌম্য পেছন থেকে বলল,
“তুমি গেলে পাখিরা কী করবে?”
আবিদ হেসে বলল, “পাখিরা কখনো হারায় না, তারা শুধু আকাশ বদলায়।” বিমান উড়ল। জানালার বাইরে অসীম মেঘের সারি, তার ওপরে নীল আকাশ
দুটি দেশ, দুটি জীবন, দুটি আকাশ।
আবিদ মনে মনে ভাবল,
হয়তো সে ফিরছে, হয়তো যাচ্ছে,
হয়তো কোনো দেশেই পুরোপুরি নেই সে।
জানালার বাইরে সাদা মেঘ,
আর দূরে উড়ছে পাখির দল সেই কানাডা গিজ, স্নো গুজ, রবিন। তাদের ডানার ঝাপটায় আকাশের রঙ বদলে যাচ্ছে। আবিদ শুধু জানে যেখানে শিকড়, সেখানেও ডানা চায়; যেখানে ডানা, সেখানেও শিকড়ের ডাক শোনা যায়।
মোহাম্মদপুরে ফ্ল্যাটের পুরোনো জানালা হয়তো এখনো খোলা থাকে বিকেলে, যেখানে রোদ এসে পড়ে, আর বাতাসে কাঁপে শুকনো জামাকাপড়। হয়তো একদিন আবিদ ফিরবে অথবা কখনোই না।
কিন্তু আকাশে উড়তে থাকা সেই পাখিগুলো জানে ফেরা মানে শেষ নয়, ফেরা মানে আবার শুরু।





















































