মো. রাইসুল ইসলাম »
কোন দেশের কোন খাতে কেমন উন্নয়ন হবে বা কোন খাতকে কেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তা বোঝা যায় সে দেশের জাতীয় বাজেট বরাদ্দ থেকে। ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে রয়েছে। আবার দেশের মোট আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়টি অধিক চ্যালেঞ্জিং। তাই দেশের সামগ্রিক বাজেট হওয়া চাই পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েই।
জাতীয় বাজেটে পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকে। পরিবেশ সম্পর্কিত খাতগুলোতে বরাদ্দ থাকে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশ্বব্যাপী ‘এনভারয়নমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স’ এ বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম হলেও পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দে তেমন কোনও অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় না। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশ সংবেদনশীলতার বিষয়টি আমলে নেওয়া হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত হয়। পরিবেশ ঠিক রেখেই উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন বাজেটে এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হবে। যখন পরিবেশ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন তখন দেখা যায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বাজেটের আকার না বেড়ে বরং ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে। যেখানে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাজেটে এই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছিল ১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা সেখানে ২০২০-২১ অর্থ বছরে এসে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয় ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ অর্থ বছরের তুলনায় ২৫০ কোটি টাকা কম। উন্নয়ন খাতেও ২০২০-২১ অর্থ বছরের বরাদ্দ পূর্ববর্তী অর্থ বছরের তুলনায় কম প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার ২০২০-২১ অর্থ বছরে এই মন্ত্রণালয়ে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা মোট বরাদ্দের মাত্র ০.২ শতাংশ।
দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান বিভিন্নভাবে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। যার মধ্যে বন উজাড়, বন্যপ্রাণী নিধন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, পাহাড় কাটা, মাটি দূষণ, নদী দূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ সমস্যা অন্যতম। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে কার্যকর পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তব প্রতিফলন থাকতে হবে। তাছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, টেকসই পরিবেশ বান্ধব ও জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষার বিষয়গুলো সঠিক মূল্যায়ন ও প্রয়োগ করা না গেলে সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বাজেটে তাই এ বিষয়কে প্রধান্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকা চাই।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে সেখানে ‘বাংলাদেশের বনভূমি ও বৃক্ষ সম্পদ সমীক্ষা প্রতিবেদন-২০১৯’ অনুযায়ী বন আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু বন অধিদফতর বনের ভেতরে ও বাইরের মিলিয়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ হিসাব করেছে সাড়ে ২২ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে বৃক্ষ রোপণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগের কারণে বনের বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে বনাঞ্চল বন্যপ্রাণী ও অন্যান্য জীবসত্তার আবাসস্থল বনাঞ্চল ধ্বংস হলে জীববৈচিত্র্যও মারাত্বক হুমকিতে পড়বে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ১৬১৯ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ৩১টি প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এছাড়াও মহাবিপন্ন, বিপন্ন ও সংকটাপন্ন তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে ৫৬, ১৮১ ও ১৫৩ টি প্রজাতি। আবার অবৈধ বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়। বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন নামক একটি ইউনিটও রয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং যথাযথ জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাই বনাঞ্চল রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্রগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় কাটা ও দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এ পাহাড় কাটার বিষয়ে বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে জাতীয় স্বার্থে অনুমতি সাপেক্ষে পাহাড় কাটা বৈধ হওয়ায় এই সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে। এক্ষেত্রে পাহাড়ের সীমানা নির্ধারণ করে তার চারপাশে গাছ লাগিয়ে বেষ্টনী তৈরি করা যেতে পারে। আবার নদ-নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে অযাচিত নদী ভাঙনের ঘটনা ঘটছে এবং মৎস্যসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শুধু জরিমানা গুনেই যেন অপরাধী ছাড় না পেয়ে যায় সেজন্য এসব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
শিল্প-কারখানা ও বাসাবাড়ির বর্জ্য মাটিতে ফেলা, কৃষি জমিতে ক্রমবর্ধমান রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন মাটি দূষিত হচ্ছে, জমির উর্বরতা কমছে অন্যদিকে তেমন মাটির গুনগত মান নষ্ট হচ্ছে এবং মাটিতে বসবাস করা জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। দেশের শিল্প-কারখানা বেষ্টিত অঞ্চলগুলোতে নদ-নদীর পানি এতটাই দূষিত যে এতে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারখানায় ব্যবহৃত পানি পরিশোধন না করে অনেক কারখানা দূষিত পানি নদীতে অবমুক্ত করছে। এক্ষেত্রে জেল-জরিমানার বিধান থাকলেও সঠিকভাবে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
তাই কারখানাগুলোতে ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) বসানোতে প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি আইন অমান্যকারীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বায়ু দূষণে দেশ নিয়মিতই চ্যাম্পিয়নের কাতারে। পরিবেশ অধিদফতরসহ অন্যান্য অধিদফতরের বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন অবৈধ ইট ভাটা বন্ধ, ইটের বদলে ব্লক ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া, রাস্তায় পানি ছিটানো, গাড়ির ইঞ্জিনের দূষণ নিরীক্ষণ করা ইত্যাদি সত্ত্বেও বায়ুদূষণ কমানো যাচ্ছে না।
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর গুরুত্ব আরও বাড়াতে হবে। ইতিমধ্যে দেশে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পসহ আরও বেশ কিছু নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের প্রকল্প চালু হয়েছে। এই রকম প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিল্পকারখানা ও বসতবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখপূর্বক সচেতনতামূলক কার্যক্রম আরও অধিক হারে চালিয়ে যেতে হবে।
আবার এখন পর্যন্ত দেশে সকল জেলায় পরিবেশ অধিদফতরের কার্যালয় নেই, তাছাড়া দক্ষ জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে পরিবেশ অধিদফতরের কাঠামো ও কার্যাবলী প্রসারিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও প্রযুক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বাজেটে এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো এবং এগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
দেশে পরিবেশ আদালত আছে মাত্র তিনটি। মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতার কারণেও জনগণ এ সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা করতেও আগ্রহী হয় না। এজন্য মানুষের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ এবং এগুলোতে তাদের অন্তর্ভূক্তি বাড়াতে হবে।
বর্তমানে সারা বিশ্ব করোনা মহামারির কবলে দিশেহারা হয়ে আছে। পুরো পৃথিবীকেই প্রায় স্থবির করে রেখেছে এই দুর্যোগ। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এরকম আরও অনেক দুর্যোগের কারণ হতে পারে। ভবিষ্যতে এর প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ হবে এমনটাই আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাই জীবকুলের অস্তিত্ব রক্ষায় পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বাজেট তৈরি করতে হবে।
পরিশেষে আমাদের মূল সুপারিশ হচ্ছে: পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে; উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশ কম্পোনেন্টের ওপর বরাদ্দ এবং জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে; নতুন জেগে ওঠা চর, দ্বীপ ও পরিত্যক্ত জায়গায় বৃক্ষরোপণের জন্য প্রকল্পের পরিমাণ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে; বহুতল ভবনের ছাদে টেকসই বাগান নির্মাণে বহুমুখী প্রকল্প হাতে নিতে হবে; বৃক্ষরোপণের প্রতি মানুষের ইতিবাচক মনোভাবকে কাজে লাগাতে হবে; মাটির গুণগত মান রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য ধরে রাখার জন্য জৈব সার ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব বালাইনাশক ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে এ সংক্রান্ত প্রকল্প ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে; জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে; কলকারখানা থেকে অপরিশোধিত পানি আশেপাশের নদীকে যেন দূষিত না করতে পারে সেজন্য কলকারখানা বহুল এলাকায় কেন্দ্রীয় ইটিপি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে; শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর ট্যাক্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করে গণপরিবহনের আধুনিকায়নে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে; পরিবেশ বিষয়ক তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং কর্মকর্তাদের কার্যাবলির স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ পর্যবেক্ষক টিম গঠন করতে হবে; প্রতিটি জেলায় অবিলম্বে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করতে হবে; পরিবেশ বিষয়ে স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে।
লেখক : গবেষক,
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ ডিভিশন,
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট
ৎধরংঁষৎধলরন১১০২৩@মসধরষ.পড়স