সুপ্রভাত ডেস্ক »
পরিবেশ সুরক্ষায় অনন্য অবদানের জন্য আলোচিত ব্যক্তিত্ব ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী পাচ্ছেন ‘পমা পরিবেশ পদক ২০২৫’।
পরিবেশ দূষণ হ্রাস, প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা, নদ-নদী ও সমুদ্রের বেপরোয়া দূষণ প্রতিরোধ এবং শিক্ষার্থীদের পরিবেশ জ্ঞানে আলোকিত করে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রশংসনীয় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে পরিবেশ মানবাধিকার আন্দোলন-পমা তাঁকে চলতি বছর ওই পদকের জন্য মনোনীত করেছে। আগামি ১৪ নভেম্বর ২০২৫ চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের জুলাই শহীদ স্মৃতি হলে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক ও সম্মাননা হস্তান্তর করা হবে।
উল্লেখ্য, চট্রগ্রাম বন্দরের ২০০০ কোটি টাকার ভূমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার এবং প্রায় ৭ হাজার দেশি বিদেশি জাহাজ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৩০ কোটি টাকা জরিমানা ও রাজস্ব আদায় করার পাশাপাশি মুনীর চৌধুরী দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে পরিবেশ সুশাসন ও নৌশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। দায়িত্ব পালনে কখনও ব্যক্তি কিংবা দলীয় পরিচয় তার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সমুদ্রপরিবহন অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক মালিকানাধীন কোকো’ লঞ্চকে কয়েকদফা আটক ও জরিমানা করে তিনি ক্ষমতাসীনদের ভিত কাঁপিয়ে দেন। এছাড়াও বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা, পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর জাহাজ আটক ও জরিমানা করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
প্রভাবশালীদের দখল থেকে উদ্ধার করেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ৫০০ কোটি টাকার মূল্যবান জমি। ওয়াসার দুর্নীতি, পানি চুরি ও রাজস্ব ফাঁকির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালিয়ে ওয়াসার সিস্টেম লস ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনেন। চট্টগ্রাম বন্দরসহ একাধারে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ম্যাজিস্ট্রেটের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকালে বিএসটিআই, বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ অধিদফতর, ট্রাফিক বিভাগ, ওষুধপ্রশাসন, বিসিক, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, সমুদ্রপরিবহন অধিদফতর, মৎস্যবিভাগের নানা অনিয়ম, বিশৃংখলা দূর করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামে ৯ শতাধিক চলাচল অযোগ্য দূষণকারী যানবাহন জব্দ এবং ৬’শ মেট্রিক টন ভেজাল খাদ্য আটক, ৮৮ জন ভেজাল খাদ্য অপরাধীকে কারাদণ্ড প্রদান এবং অর্ধশতাধিক ভেজাল খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে তিনি সড়ক ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
মুনীর চৌধুরী সারাদেশে সহশ্রাধিক দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়ে আদায় করেন ৭৪ কোটি টাকা জরিমানা। ২বছরে প্রায় ৩ শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা হয় বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপনে । অভিযানের প্রভাবে ইটিপিযুক্ত শিল্পকারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৪ শতাংশ। এছাড়া দেশজুড়ে তার অভিযানে মারাত্মক কার্বন নি:সরণকারী ৩ শতাধিক ইট ভাটা ভেঙ্গে ফেলা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় আরও দুই শতাধিক অবৈধ ইটভাটা। জব্দ করা হয় সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত কাঠ এবং পাহাড়কাটার বুলডোজার, অবৈধ কারখানার যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য দূষণকারী সামগ্রী। সম্পূর্ণ ভেঙ্গে ফেলা হয় ১১টি অবৈধ পলিথিন কারখানা। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় প্রায় ৩০টি অবৈধ কারখানার। কার্যক্রম বন্ধ করা হয় আরও অর্ধশতাধিক অবৈধ প্রতিষ্ঠানের।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে উদ্ধার করা হয় ৩১১ একর পাহাড় ও উপকূলীয় বনভূমি। এ ছাড়া অবৈধ ইটভাটার কবল থেকে সারাদেশে প্রায় ৩০০ একর ফসলি জমি উদ্ধার করা হয়। এ অভিযানের প্রত্যক্ষ প্রভাবে সনাতন পদ্ধতির ইটভাটার পরিবর্তে ২ বছরে প্রায় ১১০০ আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপিত হয়। এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজস্ব আয় ৩১কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মুনীর চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রীন বিগ্রেড’ নামক ব্যতিক্রমী পরিবেশ সংরক্ষণ টিম। পরিবেশ দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিবেশ সুবিচার থেকে বঞ্চিত মানুষের ডাকে মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশের জেলায়, উপজেলায় ও গ্রামে ছুটে গিয়েছেন। সততা ও সাহসের সঙ্গে লড়াই করে পরিবেশ-চিত্র পাল্টে দিয়েছেন দেশের বহু স্থানে। অনেক হুমকি ও পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতার মধ্যেও পরিবেশ অপরাধীদের শেকড় উপড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্থ হননি। পুলিশ, র্যাব কিংবা কোন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ছাড়াই মাঠে নেমে একাই দু:সাহসের সঙ্গে অধিকাংশ অভিযান পরিচালনা করেন।
দখলদার ও দূষণকারীদের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায় করে তার সাহসী ও সফল তৎপরতাকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘ম্যাজিক ম্যাজিস্ট্রেসি’ হিসেবে গণ্য করেন। বাংলাদেশের কোনো সরকারি কর্মকর্তা এ যাবৎ দলমত নির্বিশেষে সব অপরাধীর বিরুদ্ধে এমন সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে অভিযান চালানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি, যা মুনীর চৌধুরী করেছেন।
এছাড়া মিল্কভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনকালে মুনীর চৌধুরী লোকসানি ও দুর্নীতিগ্রস্ত এ প্রতিষ্ঠানকে সক্ষম ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি বৃদ্ধি পায় অতিরিক্ত ৭০ কোটি টাকা, উৎপাদন বেড়ে যায় ৩/৪ গুণ। আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায় মিল্কভিটা । কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির পথ বন্ধ করেন মুনীর চৌধুরী।
পরবর্তীতে ডিপিডিসির টাস্কফোর্স প্রধান হিসেবে মুনীর চৌধুরীর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সাড়ে ৩ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ চুরির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হয় ১২০০ কোটি টাকারও বেশি এবং সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে সিস্টেম লস অনেক কমে আসে। বিদ্যুৎখাতে দুর্নীতি ও জনহয়রানি হ্রাসে ঢাকা-নারায়নগঞ্জ চষে বেড়ান অবিরাম।
দুর্নীতি দমন কমিশনে মহাপরিচালক হিসেবে মুনীর চৌধুরী সর্বপ্রথম সূচনা করেন সরকারি কর্মকর্তাদের পাকড়াও করতে এনফোর্সমেন্ট অভিযান, যা দুদকের ইতিহাসে সর্বপ্রথম। এতে প্রায় চারশতাধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিচ্যুত/আটক হয়। এখানেও পরিবেশ রক্ষা অভিযান চালিয়ে পাহাড় ও বনভূমি উদ্ধার করেন ৬০০ একর, এবং ১০০ নটিকাল মাইলেরও বেশি নদী দখল মুক্ত করেন। অভিযানে উদ্ধার হয় শত শত কোটি টাকা।
বগুড়া জেলাতে মুনীর চৌধুরী ভূমিপ্রশাসনে দুর্নীতি নির্মূলে অভিযান শুরু করেন, এবং পুরো জেলায় দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপকভাবে হ্রাস করেন। ভূমি রাজস্ব আদায় বেড়ে যায় কয়েক গুণ, সরকার দলীয় ক্যাডারদের সরকারি জমি দখল প্রতিহত করেন তিনি দৃঢ়ভাবে।
সর্বশেষ জাতীয় বিজ্ঞান যাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে যোগদানের পর মুনীর চৌধুরী প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। সমগ্র যাদুঘর ক্যাম্পাসকে সবুজায়ন করেন। ইকোপার্ক, টিলা, জলাধার ও পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলেন। জাদুঘর ভ্রমণকারী হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের নিয়ে জলবায়ু রক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ,প্লাস্টিক, পলিথিন বর্জন, পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, স্বাস্থ্যসম্মত দূষণমুক্ত জীবন যাপন ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক উদবুদ্ধকরণ ও সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করে পরিবেশ শিক্ষা ও প্রচারে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন।