নকশা বহির্ভূত ভবন
নকশা লঙ্ঘন করে গড়ে উঠা ভবন শনাক্ত করছে ইমারত পরিদর্শকগণ : অথরাইজ অফিসার
ভবন নির্মাণের আগে সিডিএকে জানিয়ে কাজ শুরু করবে ভবন মালিক : ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান
নকশা বহির্ভূত ভবন নিয়ন্ত্রণে নকশা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে : স্থপতি জেরিনা হোসেন
ভূঁইয়া নজরুল <<
হালিশহর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা। একসময় ছিল জলমগ্ন নিঁচু ভূমি। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে থাকে এলাকাটি। এখন একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। এসব বহুতল ভবন গড়ে উঠতে ভবনের উভয়পাশে জায়গা খালি রাখার বিধানটি কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই।
শুধু বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা নয়, এখানকার সোনালী আবাসিক এলাকা, গোল্ডেন আবাসিক এলাকা, পশ্চিম খুলশি কৃষ্ণচূড়া আবাসিক এলাকা, জালালাবাদ হাউসিং সোসাইটি, আকবরশাহ থানাধীন শাপলা আবাসিক এলাকা, বায়েজিদ থানাধীন চন্দ্রনগর, ব্রিকফিল্ডরোড, পতেঙ্গাসহ পুরো নগরীর চিত্রই এমন। নিয়ম মেনে কেউ ভবন নির্মাণ করতে চায় না।
তবে এই নিয়ম না মানার প্রবণতাকে টেনে ধরতে উদ্যোগী হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ভবন নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে মনিটরিং বাড়াতে চাপ দেয়া হয়েছে ইমারত পরিদর্শকদের। ১৪ পরিদর্শকের সবাইকে নিজ নিজ আওতাধীন এলাকায় নকশা বহির্ভূত ভবন কিংবা অনুমোদিত নকশার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নির্মাণ করা ভবনগুলোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। এলাকায় এলাকায় এসব ভবন শনাক্ত করে নোটিশও দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ’র অথরাইজ অফিসার-২ ও ইমারত নির্মাণ কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ হাসান বলেন, ‘নির্মাণ শেষের পর নোটিশ দেয়ার চেয়ে নির্মাণের শুরুতে মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে চেষ্টা করছি। নির্মাণকালীন যদি নকশার বাইরে ভবনের কোনো অংশ কেউ বৃদ্ধি করলে তাকে সংশোধন করে ভবন নির্মাণের জন্য চাপ দিতে পারি। কিন্তু নির্মাণ শেষে তা ভাঙ্গা ভবন মালিক ও সিডিএ উভয়ের জন্য কষ্টসাধ্য।’
এজন্য কি নোটিশের পরিমাণ বেড়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইমারত পরিদর্শকরা মাঠ পর্যায়ে এসব ভবন শনাক্ত করছে এবং নোটিশ দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে ভবন মালিক তা সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছেন।
নির্মাণাধীন ভবনগুলো কিভাবে শনাক্ত করা হচ্ছে জানতে সিডিএ’র একাধিক ইমারত পরিদর্শকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নগরীর ১৪টি জোনে ১৪ জন ইমারত পরিদর্শক রয়েছেন। তারা তাদের আওতাধীন এলাকা ঘুরে নির্মাণাধীন ভবনগুলোর তথ্য সংগ্রহ করছেন। সাধারণভাবে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী একটি ভবনের তিনদিকে সর্বনিম্ন আড়াইফুট এবং সামনে পাঁচ ফুট জায়গা খালি রাখতে হয়। যদি জায়গার পরিমাণ বেশি হয় তাহলে খালি জায়গার পরিমাণও বাড়বে।
গতকাল হালিশহর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের চার নম্বর লেনের ১০ তলার একটি ভবনে গিয়ে দেখা যায় চারপাশে এমন পরিমাণ জায়গা না ছেড়েই ভবনটি গড়ে উঠছে। শুধু এই ভবনটি নয়, এমন অসংখ্য ভবন পুরো নগরীতে নির্মিত হচ্ছে। আর এতেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পরিকল্পিত আবাসন।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, ‘ভবন নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে আইনের আওতায় নিয়ে আসা অবশ্যই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু তা যেনো শুধু নোটিশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। ভবন নির্মাণ শুরুর সময়, প্রতি তলার কাজ শেষে ও নির্মাণ শেষে সিডিএকে অবহিত করার বিধান রয়েছে। এসব বিধান পুরোপুরিভাবে চালু করা গেলে নকশা বহির্ভূত ভবন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হতো।’
নকশা বহির্ভূত ভবন নিয়ন্ত্রণে নকশা নবায়ন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবন নির্মাণের সময় ভবন মালিক পুরোপুরি আইন মেনে ভবন নির্মাণের চার থেকে পাঁচ বছর পর উপরের দিকে দুটি ফ্লোর বাড়িয়ে দিলে কেউ জানার থাকবে না। এজন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নকশা নবায়ন পদ্ধতি চালু করা গেলে পরবর্তীতে আর কেউ ফ্লোর বাড়ানোর কথা চিন্তা করবে না।
নগরীতে নির্মিত ও নির্মাণাধীন প্রায় সব ভবন শতভাগ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী গড়ে উঠছে না। তা নিয়ন্ত্রণে ভবন নির্মাণের সময় নজরদারির আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে সিডিএ’র ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান ও উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে নকশা অনুমোদনের দুই থেকে তিন বছর পর ভবন মালিক নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এজন্য নতুন একটি পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছি। এই পদ্ধতির আওতায় ভবন মালিক যখন নির্মাণ কাজ শুরু করবেন, তখন একটি চিঠি দিয়ে আমাদের (সিডিএ) অবহিত করবেন। চিঠি পাওয়ার পর সিডিএ’র টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবনের চারপাশ ঠিক করে দেবে। তখন আর কেউ অনুমোদনের বাইরে ভবন নির্মাণ করতে পারবে না।’
উল্লেখ্য, ভবন নির্মাণ নিয়ে আইন না মানার প্রবণতা অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি প্রবণতা দুই ভবনের মধ্যবর্তী জায়গা খালি না রাখা। খালি না রাখায় ভবনগুলো স্বাস্থ্যসম্মত হচ্ছে না। বাতাসের প্রবাহ থাকছে না এবং পর্যাপ্ত সূর্যের আলোও প্রবেশ করছে না।