মো. আবদুর রহিম »
প্রাণ বাঁচাতেÑজীবন বাঁচাতে খাদ্য এবং খাদ্যের পুষ্টি অপরিহার্য একটি উপাদান। সুস্থ ও সবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং খাদ্যের পুষ্টি থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
খাদ্যের উপাদান ও নিরাপত্তা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সাধারণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিশে^র উন্নত বা অনুন্নত দেশের সব নাগরিক কোন না কোনভাবে খাদ্যের পুষ্টি উপাদান ও খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু না কিছু জ্ঞান অর্জন করে থাকে। আমাদের বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে নারী-পুরুষ সকলের খাদ্যের পুষ্টি উপাদান ও খাদ্যের নিরাপত্তা বিষয়ে জ্ঞান থাকাটাও আবশ্যক। অক্ষর জ্ঞান, অল্প শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা থাক আর না থাক খাদ্যের নিরাপত্তা বিষয়ে জ্ঞান প্রয়োজন। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে খাদ্যের পুষ্টি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
২০২১ সালে সরকার ‘টেকসই উন্নয়ন সমৃদ্ধ দেশ, নিরাপদ খাদ্যে বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পাশাপাশি খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার ও পুষ্টি নিশ্চিত করণে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করে ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান প্রনয়ন সহ জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি, ভেজাল ও দূষণ বিরোধী অভিযান পরিচালনা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যক্রম ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে, সফলভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণে ক্যান্সার, কিডনিরোগ, বিকলাঙ্গতাসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সৃষ্টি হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বেগবান করা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। সরকার নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের জন্য বিভিন্ন সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বিজ্ঞানসম্মতভাবে সম্পাদন করে যাচ্ছে। এছাড়া পুষ্টিখাতকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিনীতি-২০২০’ এবং ‘জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা-২০২০’ এবং ‘জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্প ২০১৬-২০২৫’ সহ বিভিন্ন সেক্টরাল পলিসির আওতায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সম্প্রীতি প্রণয়ন করা হয়েছে ‘গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস’ (জিএপি) নীতিমালা। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে অপুষ্টির ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
শৈশবকালীন খর্বাকৃতির হার ২০১৩ সালে ৪২ শতাংশ থেকে ২০১৯ এ ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে এখনও বহু মানুষ অপুষ্টিসহ নানাবিধ রোগব্যাধির শিকার হয়ে জীবনযাপন করছে।
সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে এ এক বিরাট অন্তরায়। বৈশি^ক দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজির একটি অন্যতম সূচক হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকল মানুষ, বিশেষ করে অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, দরিদ্র জনগণ ও শিশুদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারসহ বছরব্যাপী নিরাপদ, পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এই প্রত্যয়ে সামনে রেখেই বর্তমান সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ ও ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনগণের নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস নিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সচেতনতার সাথে পুষ্টি সংবেদনশীল দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা (ঈওচ২) বাস্তবায়ন কাজ মনিটরিং করে যাচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে খাদ্যের যোগান আসে কৃষি, পশুসম্পদ ও মৎস সম্পদ থেকে এদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় কৃষি, পশু সম্পদ ও মৎস সম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। নানা প্রতিকূলতার মাঝে এবং বিগত বছরগুলোতে গবেষণায় উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাত ও উৎপাদন পদ্ধতির প্রযুক্তি সমূহ কৃষক ও খামারিদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার ফলে দৃশ্যমান ফসল, পশু ও মৎস্য উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার মাত্রা প্রশংসনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষির সকল শাখা কৃষি, (পশু সম্পদ ও মৎস্য সম্পদ) উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ বিশে^র দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ ৩য়, ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশে^ ২য়, ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে ৪র্থ, গবাদি পশু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ ১২তম, কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম আর মৌসুমী ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশে^ বর্তমানে ১০ম। খাদ্যের উপাদান প্রধানত: ৬টি। পানি, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেল। এ ৬টি উপাদান বাংলাদেশে বিদ্যমান।
দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিনই আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া দরকার। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একজন মানুষের কমপক্ষে প্রতিদিন মোট ৪০০ গ্রাম সবজি ও ফল খাওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ সবজি ২০০ গ্রাম, পাতা জাতীয় সবজি ১০০ গ্রাম এবং ফল ১০০ গ্রাম। ঐওঊঝ এর ২০১৬ এর তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১ দিনে ফল ও সবজি গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ২০৩.১ গ্রাম যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। আমরা অনেক সময় পর্যাপ্ত খাদ্যের মধ্যে থেকেও খাদ্যের পুষ্টি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা না থাকায় স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী সঠিক খাদ্য নির্ধারণ করতে পারি না। তাই সকলেরই খাদ্যে পুষ্টি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকা প্রয়োজন। সাধারণত খাদ্যের কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে খাদ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় (ক) শক্তি উৎপাদনকারী খাদ্য যেমনÑ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট (খ) শরীর গঠনকারী খাদ্য যেমন প্রোটিন (গ) রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য যেমন ভিটামিনস ও মিনারেল। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের প্রধান উৎস হলো চাল, ময়দা, ভুট্টা, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি। ঠিক প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হল মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল জাতীয় শস্য ইত্যাদি। ফ্যাট জাতীয় খাবারের প্রধান উৎস হলো বিভিন্ন প্রকার তেল যেমন; সয়াবিন তেল, সরিষার তৈল, ঘি ইত্যাদি। রোগ প্রতিরোধের জন্য দরকারী ভিটামিন ও মিনারেলস এর প্রধান উৎস হলো বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি ও ফলমূল। এই খাদ্য উপাদানগুলো কোনটি বেশি বা কোনটি অল্প পরিমাণে আমাদের শরীরে দরকার। খাদ্যের নিরাপত্তা হল এক বা একাধিক পদক্ষেপ যা ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদ্যকে খাদ্যের বিভিন্ন বিপত্তি থেকে রক্ষা করা। আমরা বিশ^াস করি জনসাধারণের সচেতনতা ও অংশীজনের কার্যকর ভূমিকায় বাংলাদেশ সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক