নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি

কষ্টে আছে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক »

চালের উৎপাদন, বিপণন, মজুত ও আমদানি-সবকিছুতেই এবার রেকর্ড হয়েছে। অথচ নিত্যপণ্যের বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, মাছ-মাংস, আটা-ময়দা, সবজিসহ সব ধরনের খাদ্যের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাজারে কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি নেই। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে কষ্টে আছে মানুষ।

জানা গেছে, মোটা চাল ৫০ টাকার উপরে, সরু চাল ৭০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল এক লিটার ১৭৫ টাকা, চিনি ৯০ টাকা মসুর ডাল মানভেদে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৬৫ টাকা, গরুর মাংস ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, ডিম ডজন ১৪০ থেকে ১৮৫ টাকা ও সবজির দাম বেড়েছে গড়ে দ্বিগুণ।

বাজারে কোনো পণ্যের দাম স্থির নেই। দামের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তারা। ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছেন তারা। আয়ের তুলনায় ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে পরিবারগুলোতে তৈরি হয়েছে বাজার ভীতি। টিসিবি’র লাইনও অনেক দীর্ঘ। বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার এমনটাই মনে করছে সাধারণ মানুষ।

নিত্যপণ্যের দামের এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার জন্য করোনায় উৎপাদন কমে যাওয়া, জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির ইস্যু, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতা ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। আবার কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ বাজারের সুশাসনের অভাবকেও দায়ী করছেন।

সূত্রমতে, চলতি অর্থবছর সাড়ে ৩ কোটি টন চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের লাইনে আছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ টন চাল। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত থাকবে ১ কোটি ১৮ লাখ টন। আগে কখনোই এত বেশি চাল উদ্বৃত্ত হয়নি। বিভিন্ন সূত্র বলছে, আগে শুধু মিলারদের কাছে ধান মজুত থাকতো। এবার শুধু মিলার নয়, মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী, বড় বড় অনেক কোম্পানি, এমনকি অনলাইন ব্যবসায়ীরাও ধান/চাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আবার মজুতও করছে।

সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, উদ্বৃত্ত থাকা সওে¡ চালের দাম ক্রমাগত বাড়ছে কেন? এ ছাড়া প্রতি বছর ভরা মৌসুমে চালের দাম কমলেও এবার কমেনি বরং বেড়েছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, বাজারে কারসাজি চলছে, যা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কারসাজি শুধু চাল, ডাল, তেলের বাজারেই সীমাবদ্ধ নয়, এখন প্রত্যেকটি পণ্যের উপর সিন্ডিকেটভুক্ত কারসাজি চলছে। আগে রোজায় দাম বাড়তো, এখন সিন্ডিকেটরা নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে এসে সারাবছরই দাম বাড়াচ্ছে। যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে, যে কোন একটি ইস্যুকে দাড় করিয়ে সেসব খাদ্যপণ্যও চলে গেছে সিন্ডিকেটের কবজায়। বাজারে সব পণ্যেই এখন ঊর্ধ্বমুখী। করোনা মহামারির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের এমনিতেই বেকারত্বতার অভিশাপ থেকে অনেকেই এখনো মুক্তি পায়নি। খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত দামবৃদ্ধি তাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই খাদ্যপণ্যের কারসাজি রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। আর তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবি’র হিসাবে গত এক সপ্তাহে চাল, ময়দা/আটা, ডিম, মুগডাল দাম বেড়েছে। এর মধ্যে মোটা (স্বর্ণা-চায়না-ইরি) চাল ৪.২ শতাংশ, মাঝারি (পাইজাম-লতা) চাল ৩.৮৪ শতাংশ, সরু (নাজির-মিনিকেট) ৫.০০ শতাংশ বেড়েছে এক সপ্তাহে। এছাড়া এক সপ্তাহের ব্যবধানে আটা সাদা (খোলা) কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা, প্যাকেটজাত আটা ৫৮ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিম (লেয়ার) প্রতি হালি ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে ডাল, জিরা, লবঙ্গ ও মুরগির দামও।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী তারেক মাসুদ বলেন, দাম কমাতে সরকারকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে যেসব বড় ব্যবসায়ী সিস্টেমের বাইরে কাজ করেন তাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।

বহদ্দারহাটের মুদি ব্যবসায়ী মাহমুদ বলেন, প্রথমত-সরকারকে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট হার কমাতে হবে। এ ছাড়া যারা আমদানি করে তাদের থেকে পণ্য ডিলার, এরপর পাইকার, এরপর খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছে কয়েক হাত যেতেই দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। একই পণ্যে কয়েকবার ভ্যাট আদায় হচ্ছে। এতেও পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সূত্রে জানা গেছে, সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সুযোগসন্ধানী আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম বাড়ে তখন সঙ্গে সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। যখন দাম কমে, তখন পণ্যের দাম কমার প্রবণতা দেখা যায় না। তিনি বলেন, আয় বৈষম্য বেশ বেড়েছে। বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। কিন্তু উন্নয়নের মহাসড়কে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যদি পিষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেই উন্নয়ন আমাদেরকে পিষ্ট করবে। এজন্য সরকারকে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

সরেজমিন দেখা গেছে, টিসিবি’র ন্যায্যমূল্যের ভোগ্যপণ্যের জন্য ট্রাকের সামনে দীর্ঘ লাইন পড়েছে। লাইনে এখন মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-বিত্তদের একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। যে কারণে টিসিবি’র ট্রাকের সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড় প্রতিদিনই বাড়ছে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। অন্যধিকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে আঘাত আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত আব্দুল রশিদ নামে এক শিক্ষক বলেন, ২২ হাজার টাকা বেতনে আগে পরিবারে সব ধরনের খরচ ও মাস শেষে কিছু টাকা সঞ্চয় করা যেতো। কিন্তু এখন পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এভাবে বাড়তে থাকে মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও গভীর হবে।

জাকারিয়া নামে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত ব্যয় বাড়লেও আয় আগের পরিমাণই আছে। এই অল্প বেতনে পরিবার চালানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন এখন শুধু ফোকাস করে বেড়ায়। বাজারে কোন ধরনের তদারকি নেই। সবকিছুর দাম বাড়তি। মধ্যবিত্ত হয়ে তার মধ্যে পড়াশুনা করে কাউকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না আদৌ জীবনটি কিভাবে পরিচালনা করছি।

বাজারে দেখা গেছে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি বড় দানার মসুর ডাল ছিল ৮০ টাকা উপরে ওই ডাল বর্তমান বিক্রি হচ্ছে ১১০-১২০ টাকা কেজি। সয়াবিন তেল খোলা ১২২-১২৪ টাকা বর্তমানে ওই খোলা (সুপার) তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেল ছিল ১২৫-১৩৫ টাকা। তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭৮ থেকে ১৮৫ টাকায়। চিনি বিক্রি হতো ৬৫-৭০ টাকা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকা। আটা (প্যাকেট-খোলা) ২৮-৩৩ টাকা বর্তমানে ৫৫-৫৮ টাকা। গুঁড়া দুধ মানভেদে ৫০০-৬৩০ টাকা এখন ৬৯০-৮৫০ টাকা। মুরগি ব্রয়লার ১১০-১২০ টাকা বর্তমানে ১৬০-১৭০ টাকা। সরু চাল ৫৮-৬৪ এখন বিক্রি হচ্ছে এখন ৬৫-৭০ টাকা। আর মোটা চাল বর্তমানে ৫০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।

আলু, পটল, বেগুন, বরবটি, কাকরোল, কচুর গাটি, করলা, টমেটো বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া একটি লাউ ৫০ থেকে ৬০ টাকা। শীতকালীন সবজি শিম প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। আর দেশি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। আর করলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি।

সবজি বিক্রেতা বাশার বলেন, বাজারে ক্রেতা তেমন না কমলেও চাহিদা কমেছে। যেসব ক্রেতা আগে ব্যাগভর্তি সবজি কিনতেন তারা এখন হিসেব করে কিনছেন।