এমরান চৌধুরী »
সহপাঠিদের চোখে নারায়ণ স্যার রসের খনি। আমাদের ফার্স্টবয় শান্তনু বলে, রসের খনি নয়- বলা উচিত ঘন রসের খনি। প্রাথমিক অবস্থায় রস হালকা। জ্বাল দেয়ার পর সে-রস হয়ে ওঠে ঘন। হালকা রসের চেয়ে ঘন রসের স্বাদই আলাদা। সে-রস খাওয়ার অনেকক্ষণ পরও স্বাদটা লেগে থাকে জিভে। নারায়ণ স্যারও তেমনি।
নারায়ন স্যার আমাদের অংক পড়ান। মানে ম্যাথের টিচার। ম্যাথের টিচাররা সচরাচর যে রকম হন স্যার তেমনটা নন। চোখে পুরু লেন্সের চশমা, গুরুগম্ভীর ভাব আর একটু মেজাজী। এই হলো ম্যাথের টিচার। কিন্তু নারায়ণ স্যার সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের এক মানুষ। তাঁর মুখে লেগে থাকে অহর্নিশ হাসি, যেন বা শাদা কাশফুল হাসছে। এই মাত্র গোসল সেরে আসার মতো সজীবতা তাঁর দু চোখে। যেখানে খেলা করে স্বপ্নময় মায়াবী এক জগত। ফলে, ভয়ের বদলে সে জগতের মানুষটি আমাদের কাছে আগ্রহের প্রতীক হয়ে উপস্থিত হন প্রতিদিনই।
পাঠ্যভুক্ত সব বিষয়ের মধ্যে ম্যাথটা একদম তেতো। এটা না যায় সহজে গেলা না যায় ফেলে দেয়া। যেন বা ম্যালেরিয়ার বড়ি। তাই আমাদের ক্লাসের ছাত্ররা এটার নাম রেখেছে পাডাপাডি গণিত। কিন্তু নারায়ণ স্যার আমাদের সে ধারণা পাল্টে দিয়েছেন। তিনি পাডাপাডি গণিতকে ‘সহজ পাটিগণিত’ করেই ছাড়ছেন।
নারায়ণ স্যারের পিরিয়ডটা ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়, অনেকটা পাখির মতো। কী করে যে যায় তা টেরই পাই না আমরা। আসলে স্যারের উপস্থাপনার ভঙ্গি যেমন মজার তেমন আলাদা অংক কষার ধরন। যে কোন জটিল বিষয়ও তাঁর বলার ঢঙে হয়ে ওঠে জলবৎ তরলং যা আমাদেরকে কাছে টানে চুম্বকের মতো। আমরা হরিণশাবকের মতো কান খাড়া রেখে শুনি আর চেয়ে থাকি। এ যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রিয় নেতার ভাষণ শোনা।
অংকের যে কোন পার্ট কষাবার আগে স্যার বর্ণিত বিষয়ের সাথে নিজের বুদ্ধি বিবেচনার সমাবেশ ঘটান। নিয়মের সাথে টেনে আনেন নানা রসালো বিষয়ের। ফলে একইসাথে রস ও কষ দুটোরই সাধনা চলে সমান তালে। সেদিন পার্ট ছিল ‘ঐকিক নিয়ম’- এর। স্যার ক্লাসে এসে বসেই বললেন, আজ তোদের ‘একের নিয়ম’ শেখাবো। আমরা সবাই হতবাক। স্যার বলেন কি, মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে সবাই হা করে চেয়ে থাকি। স্যার আমাদের দিকে এক দৃষ্টি তাকালেন এবং বললেন, কিরে- সব হা করে রইলি যে? এতগুলো ‘হা’ একসাথে হলে কি হয় জানিস!
শান্তনু নড়েচড়ে বসল। বোধহয় কিছু একটা বলতে চাইল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার সে ‘হা’-তে যোগ দিল। আমি বুকে আলতো থুথু ছিটিয়ে বললাম, ‘হাহাকার হয় স্যার’। স্যার হেসে উঠলেন। সে সাথে পুরো ক্লাস ‘হা’ থেকে হা হা হয়ে সশব্দে ফেটে পড়ল। হাসি থামলে শান্তনু দাঁড়িয়ে বলল- একের নিয়ম বলতে তো কোন নিয়ম নেই স্যার? ওহ্ তাই। স্যার বলা শুরু করলেন ঐকিক থেকে এক। এই নিয়মে যতো কাজ কারবার একেরই। ‘এক’-এ বাড়ে ‘এক’- এ কমে। তিন লাইনের এ অংকে ‘এক’- এর মানে দু’রকমের হয়। কখনো হয় বেশি, কখনো হয় কম। যখন বেশি হয় তখন গুণ, আর যখন কম হয় তখন ভাগ করতে হয়। নারায়ণ স্যারের ‘এক’- এর মাহাত্ম্য শুনে সেদিনই সবার ঐকিক নিয়ম রপ্ত হয়ে যায়।
নারায়ণ স্যারের মাথাটা আমাদের ভাবনার বিষয় হয় মাঝেমধ্যে। ছোট একটা মাথা, মাঝখানে দু’এক গাছি চুল। গুনলে বড় জোর গোটা বিশেক হবে আর বাকীটা সাতত্রিশ সাবানের কার্বন কপি। আর তাতে এত ঘিলু, এত বুদ্ধি। যত ভাবি তত বিস্মিত হই, সে সাথে শ্রদ্ধায় ভরে উঠে মন। যে ‘সরল’-কে আমরা এতদিন গরল বলেই ভাবতাম, সে সরলই সবচেয়ে সহজ আজ আমাদের কাছে।
‘ইঙউগঅঝ’
স্যার বললেন-এ ‘ইঙউগঅঝ’ শব্দটা মনে রাখলে গরল সরল হয়ে যায়। স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করলেন।
‘ইঙউগঅঝ’-এর ই মানে ইৎধপশবঃং- যার অর্থ বন্ধনী। ঙ-তে হয় ড়ভ যার অর্থ এর। উ-তে হয় উরারংরড়হ।
উরারংরড়হ শব্দটা লিখে স্যার বললেন, এটার অর্থ নিয়ে আবার তালগোল পাকিয়ে ফেলিস না। এটা কেউ ঋরৎংঃ উরারংরড়হ-এর উরারংরড়হ বা চিটাগাং উরারংরড়হ ভেবে বসিস না। এর সোজা অর্থ ভাগ, মানে ভাগ করা। এবার দেখা যাক গ দিয়ে কী হয়? গ-এ হয় গঁষঃরঢ়ষরপধঃরড়হ যার অর্থ গুণ। অ- তে হয় অফফরঃরড়হ- যোগ। আর সবশেষে ঝ। ঝ- এ কি হয় কেউ জানিস না কি?
জানি স্যার। শান্তনু বলল- ঝঁনঃৎধপঃরড়হ। স্যার বললেন- কি ট্রাক্টর বললি!
ট্রাক্টর নয় স্যার, বলছি ঝঁনঃৎধপঃরড়হ। যার অর্থ বিয়োগ।
আসলে স্যার ঞৎধপঃরড়হ ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু ঞৎধপঃরড়হ-কে ট্রাক্টর বলে মজা করছেন।
তাহলে ‘ইঙউগঅঝ’ এর পুরো অর্থ হল বন্ধনী, এর, ভাগ, গুণ, যোগ ও বিয়োগ।
এখানে আর একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি, রেখা বন্ধনী যদি থাকে সেটির কাজ সবার আগেই করতে হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে ১ম, ২য়, ৩য় বন্ধনীর ভেতরের কাজ করে যেতে হয়।
সবার মনে থাকবে তো সূত্রটা?
মনে থাকবে মানে, খুব মনে থাকবে স্যার। সমস্বরে সবাই জবাব দিতেই ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে ওঠে।