সুপ্রভাত ক্রীড়া ডেস্ক »
হাসান আলির বলে কেমার রোচের ড্রাইভে বল ছুটল কাভার দিয়ে। দুই রান নেওয়ার পথেই উদযাপন শুরু করলেন রোচ ও জেডেন সিলস। ড্রেসিংরুমে তাদের সতীর্থরাও তখন লাফাচ্ছেন। গ্যালারির গুটিকয় দর্শকের আনন্দ চিৎকারে প্রকম্পিত চারপাশ। ধারাভাষ্যকক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন ইয়ান বিশপ, “ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে গেছে… অবিস্মরণীয় টেস্ট জয়। রোচ ও সিলসকে কুর্নিশ…১ উইকেটের জয়, স্রেফ ১ উইকেটের…।” পাকিস্তানিরা তখন হতাশায় নুইয়ে পড়েছে প্রায়।
শেষের ওই টুকরো টুকরো ছবিগুলোই ফুটিয়ে তোলে ম্যাচের বাস্তবতা। পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকা জ্যামাকাই টেস্ট রোমাঞ্চের ভেলায় চেপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে নেয় শেষ জুটির ব্যাটিং দৃঢ়তায়।
১৪ উইকেট পতনের নাটকীয় চতুর্থ দিনে হয়ে যায় ম্যাচের ফয়সালা। দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথমটি ১ উইকেটে জিতে সিরিজে এগিয়ে ক্যারিবিয়ানরা। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন আসরেও তাদের শুরুটা হলো জয় দিয়ে।
দারুণ বোলিংয়ে জয়ের ক্ষেত্র আগেই গড়ে দিয়েছিলেন রোচ ও সিলস। কে জানত, ব্যাটিংয়েও তাদের দিকে তাকিয়ে ধাকবে দল!
শেষ জুটিতে রোচের সঙ্গে যখন উইকেটে যোগ দেন মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা সিলস, জয় তখনও ১৭ রান দূরে। দুই পেসার মিলে সেই কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে দলকে উপহার দেন জয়ের উচ্ছ্বাস।
টেস্ট ইতিহাসের ১৫তম ১ উইকেটের জয় এটি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৃতীয়।
পাকিস্তান এ দিন ধরা দেয় তাদের চিরায়ত রূপে। কখনও দুর্দান্ত, কখনও সাধারণ। ব্যাটিং ধসের পর অসাধারণ বোলিং। চোখধাঁধানো এক ক্যাচ নেন মোহাম্মদ রিজওয়ান, কিন্তু ছাড়েন আরেকটি। দারুণ বোলিং করেন হাসান আলি, কিন্তু ছেড়ে দেন সহজ ক্যাচ।
অপরাজিত ৩০ রানে মহামূল্য ইনিংস খেলে শেষের নায়ক যিনি, সেই রোচ জীবন পান ৫ ও ১৬ রানে। দুবারই বোলার ছিলেন শাহিন শাহ আফ্রিদি।
শেষের ওই নাটকীয়তায় অনেকটাই আড়াল হয়ে যায় সকালের ভূতুড়ে সেশন। এক সেশনেই পতন হয় ৮ উইকেটের!
দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটে ১৬০ রান নিয়ে পাকিস্তান শুরু করে চতুর্থ দিন। লিড বাড়ানোর আশা তাদের বড় ধাক্কা খায় দিনের শুরুতেই। দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান ফাহিম আশরাফ ও বাবর আজম ফেরেন দ্রুত।
রোচের বলে জশুয়া দা সিলভার দুর্দান্ত ডাইভিং ক্যাচে ফাহিম থামেন ২০ রানে। ৫৪ রানে শুরু করে বাবর যোগ করতে পারেন আর এক রান। কাইল মেয়ার্সের বাড়তি বাউন্স তার ব্যাটে ছোবল দিয়ে সহজ ক্যাচ যায় স্লিপে।
দুটি করে চার ও ছক্কায় হাসান আলি ২৮ রানের ইনিংসে দুইশ ছাড়ায় পাকিস্তান। তবে টানা তিন ওভারে উইকেট নিয়ে তাদের ইনিংস গুটিয়ে দেন সিলস।
দারুণ পারফরম্যান্সে ম্যাচের সেরা ১৯ বছর বয়সী সিলস। ছবি: উইন্ডিজ ক্রিকেট।
দারুণ পারফরম্যান্সে ম্যাচের সেরা ১৯ বছর বয়সী সিলস। ছবি: উইন্ডিজ ক্রিকেট।
প্রথম ইনিংসের ৩ উইকেটের সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসের সিলসের শিকার ৫ উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ড এখন তার (১৯ বছর ৩৩৬ দিন)।
প্রথম ইনিংসের লিড মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৬৮ রানের। সেই রান তাড়ায় শুরুতেই ধস নামে তাদের টপ অর্ডারে। শাহিন শাহ আফ্রিদির আগুনে বোলিংয়ে প্রথম তিন ব্যাটসম্যানকে হারায় তারা ১৬ রানের মধ্যেই।
সেই বিপর্যয় থেকে দলকে উদ্ধার করে রোস্টন চেইস ও জার্মেইন ব্ল্যাকউডের জুটি। ব্ল্যাকউড যথারীতি আগ্রাসী খেলে দলের রান বাড়ান দ্রুত।
৬৮ রানে এই জুটি শেষে জোড়া ধাক্কা। ফাহিম আশরাফ ফিরিয়ে দেন চেইস (২২) ও কাইল মেয়ার্সকে। ম্যাচে দুই ইনিংসেই শূন্যতে ফেরেন মেয়ার্স।
ব্ল্যাকউড পেরিয়ে যান ফিফটি। তবে আবার তাদের জোড়া ধাক্কায় নাড়িয়ে দেন হাসান আলি। ৫৫ রানে ব্ল্যাকউডকে থামানোর পর এই পেসার শূন্য রানেই বোল্ড করে দেন জেসন হোল্ডারকে।
রোচের ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং পর্ব শুরু সেখান থেকে। জশুয়া দা সিলভার সঙ্গে তার জুটি হয় ২৮ রানের। আফ্রিদির বলে রিজওয়ানের ক্যাচে জশুয়া বিদায় নেন ১৩ রানে।
এরপর হাসান আলির বলে কিপিং থেকে পেছন দিকে প্রায় ৪৫ গজ দৌড়ে রিজওয়ান যখন অসাধারণ ক্যাচে ফেরালেন ওয়ারিক্যানকে, ম্যাচে তখন ফেবারিট পাকিস্তানই।
কিন্তু শেষের আগে কিছুই শেষ নয় বলেই তো খেলাটা ক্রিকেট! দুই দফায় জীবন পেয়ে এগিয়ে গেলেন রোচ। শেষ দিকে আরেকবার তার ব্যাটের কানায় লেগে বল অল্পের জন্য গেল না রিজওয়ানের গ্লাভসে, উল্টো হয়ে গেল চার রান। শেষ জুটিতে তাকে বুক চিতিয়ে সঙ্গ দিলেন তরুণ সিলস। স্মরণীয় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ল ক্যারিবিয়ানরা।
ম্যাচে ৮ উইকেট আর শেষ সময়ের ভূমিকায় ম্যান অব দা ম্যাচ সিলস। জ্যামাইকাতেই দ্বিতীয় টেস্ট শুরু শুক্রবার থেকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
পাকিস্তান ১ম ইনিংস: ২১৭
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ম ইনিংস: ২৫৩
পাকিস্তান ২য় ইনিংস: ৮৩.৪ ওভারে ২০৩ (আগের দিন ১৬০/৫) (বাবর ৫৫, ফাহিম ২০, ইয়াসির ৪, হাসান ২৮, আফ্রিদি ০, আব্বাস ১*; রোচ ১৯-৮-৩০-৩, সিলস ১৫.৪-৩-৫৫-৫, মেয়ার্স ১৫-৫-৩৩-১, হোল্ডার ১৮-৬-৩৬-১, ওয়ারিক্যান ৭-২-২৮-০, চেইস ৬-২-১২-০, ব্র্যাথওয়েট ৩-১-৩-০)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ১৬৮) ৫৬.৫ ওভারে ১৬৮/৯ (ব্র্যাথওয়েট ২, পাওয়েল ৪, বনার ৫, চেইস ২২, ব্ল্যাকউড ৫৫, মেয়ার্স ০, হোল্ডার ১৬, জশুয়া ১৩, রোচ ৩০*, ওয়ারিক্যান ৬, সিলস ২*; আব্বাস ১২-৫-২৭-০, আফ্রিদি ১৭-৪-৫০-৪, হাসান ১৬.৫-৫-৩৭-৩, ফাহিম ৮-১-২৯-২, ইয়াসির ৩-০-১৩-০)।
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ উইকেটে জয়ী
সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১-০তে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: জেডেন সিলস।