সুপ্রভাত ডেস্ক »
বুধবার উদ্বোধনের পর বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে মেট্রো রেলের বাণিজ্যিক যাত্রী পরিবহন সেবা। সাধারণ নাগরিকদের জন্য মেট্রো রেল খুলে দেওয়ার পর প্রথম দিন থেকেই দূর দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষের ভিড় করেন উত্তরা ও আগারগাঁও স্টেশনে। খবর বিবিসি বাংলার।
পূর্ব-ঘোষণা অনুযায়ী সকাল আটটা থেকে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম শুরু হলেও তারও আগে থেকে স্টেশনের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন বয়সীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভিড় বাড়তেই থাকে।
যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগই কোন কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নয় বরং শুধু মেট্রো-রেলে চড়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন।
মোহাম্মদ শিপন মিয়া শীতের সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে উত্তরা দিয়াবাড়ির এই স্টেশনে চলে এসেছেন প্রথম দিনের মেট্রো-রেলে অভিজ্ঞতা নিতে।
‘দুই ঘণ্টা হল লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কষ্টকে কষ্ট মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রথম মেট্রো-রেল হয়েছে এটায় প্রথমবার চড়বো। কোন কাজে যাচ্ছি না জাস্ট ঘুরার জন্যই। আমি খুব এক্সাইটেড’ বলছিলেন তিন।
তবে সকাল থেকেই উত্তরা ও আগারগাঁও স্টেশনে টিকেট কাটতে গিয়ে বিভ্রাটে পড়তে দেখা গিয়েছে যাত্রীদের। দুটি স্টেশনে তিনটি করে টিকেট কাটার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র থাকলেও সেগুলো বিকল হয়ে পড়ায় সব যাত্রীদের কাউন্টারে ভিড় করতে হয়। ভ্রমণের চাইতে দ্বিগুণ সময় লাইনে দাঁড়িয়েই ব্যয় হয়েছে যাত্রীদের।
এ কারণে বাইরে যতোটা ভিড় দেখা গিয়েছে মেট্রো রেলের ভেতরে তেমন কোন ভিড় চোখে পড়েনি।
টিকেট নিয়ে এই বিভ্রাটের বিষয়ে অপরেশন্স বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মো. ইফতেখার হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিন একসঙ্গে মেশিনে প্রচুর নক হয়েছে তাই কিছুটা হ্যাং হয়ে গিয়েছে। আমরা এটা ঠিক করছি। যেহেতু নতুন, তাই এতো ভিড় যা পরে আর থাকবে না। মেট্রো রেল বাংলাদেশে প্রথম, সবাই শিখছে, আমরাও শিখছি। আমাদেরও সময় দরকার।’
তবে যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে প্রবেশ মুখ থেকে শুরু করে কাউন্টার, স্ক্যানিং ডোর এবং স্টেশন জুড়ে অনেক পুলিশ, আনসার ও রোভার স্কাউট সদস্যদের দেখা যায়। তারা মূলত যাত্রীদের প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করতে সহায়তা করছিলেন।
ঢাকা জেলা রোভার স্কাউট মোহাম্মদ সোহাগ হোসেন বলেন, ‘আমরা এখানে দুটা জোন রয়েছে, পেইড আর আনপেইড। আনপেইড জোন থেকে যাত্রীরা টিকেট কালেক্ট করবেন তার পেইড জোনে তারা টিকেট স্ক্যান করে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করবেন। আমরা তাদেরকে পুরো বিষয়টায় সাহায্য করছি।’
মেট্রো রেলের ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে থামার পর সেখানে ট্রেনের দরোজার সামনে বাড়তি আরেকটি দরজা ও ব্যারিকেড রয়েছে।
এর কারণ হিসেবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাধারণ মানুষ যেন স্টেশনের সতর্কতামূলক লাইন অতিক্রম না করে সেজন্যই এই বাড়তি দরজা বসানো হয়েছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে এই বাড়তি দরজা ও ব্যারিকেড বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
উত্তরা থেকে টিকেট কেটে ট্রেনে ওঠার পর দেখা গেল প্রত্যেক যাত্রী তাদের মোবাইল ফোনে হয় ভিডিও করছেন, ছবি তুলছেন, বা ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং করছেন। অনেকে ভিডিও কলে প্রিয় মানুষকে তার অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন।
ট্রেন থেকে নামার পর একটি পরিবারের সাথে দেখা। তারা ব্যস্ত ছিলেন ট্রেনের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে।
পরিবারের গৃহিনী সাবিনা ইয়াসমিন জানান, তারা সুদূর রাজশাহী থেকে এসেছে মেট্রো-রেলে চড়ার অভিজ্ঞতা নিতে।
‘ভীষণ ভীষণ এক্সাইটেড, খুবই মজা লাগলো। খুবই অহংকার বোধ করছি। সময় অনেক বাঁচল। কষ্টের পরে কেষ্ট মেলে। ভোগান্তির পর ধৈর্য ধরার ফল এখন পাচ্ছি’ বলেন সাবিনা ইয়াসমিন।
ফেরার পথে দেখা হয় বাংলাদেশ হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মোহাম্মদ মোহসিনের সঙ্গে।
তিনি আগারগাঁও থেকে উত্তরা স্টেশনে এসেছেন। কারও সহায়তা ছাড়া এতো নিরাপদে ভ্রমণ করতে পেরে অনেকটাই খুশি তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা যারা হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী, আমাদের জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠা রীতিমতো অসম্ভব। সিএনজিও নিতে চায় না। আজকে আমি কারও সহায়তা ছাড়াই মেট্রোরেলে ভ্রমণ করলাম। টিকেট কাটা. প্ল্যাটফর্মে যাওয়া, ট্রেনে ওঠা, ওয়াশরুম সব কাজ একা একা করতে পেরেছি। আগে কখনও এমনটা কল্পনাও করিনি। ’
ট্রেনের মোট ছয়টি কোচের চিত্র একই। মাঝের চারটি কোচে ধারণ ক্ষমতা ৩৯০ জনের মতো। এবং দুই পাশের ট্রেইলার কোচের ধারণ ক্ষমতা ৩৭৪ জন। সে হিসেবে একটি ট্রেন একেবারে ২৩শ জন যাত্রী বহন করতে সক্ষম।
এক কোচ আরেক কোচ ঘুরতে ঘুরতেই ট্রেন পৌঁছে যায় আগারগাঁও স্টেশনে। সময় লেগেছে ১৪ মিনিটের কিছু বেশি।
সড়কপথে এজন্য পাড়ি দিতে হতো ১৭ কিলোমিটার পথ। বৃহস্পতিবারের মতো ব্যস্ত দিনে ঢাকায় সড়কপথে এতোটা দূরত্ব এতো কম সময়ে অতিক্রম করা রীতিমতো অসম্ভব বিষয় ছিল। সব মিলিয়ে যাত্রীদের মাঝে এক উৎসবের আমেজ দেখা যায়।
বৃহস্পতিবার যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার প্রথম দিনে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা ট্রেন চলাচল করেছে।
এই দূরত্বের মাঝে নয়টি স্টেশন থাকলেও আপাতত কোন স্টেশনেই ট্রেন থামবে না। সরাসরি উত্তরা থেকে আগারগাঁও যাত্রী পরিবহন করবে।
প্রথম দিনের যাত্রায় মোট ৫০টি ট্রিপে ৩৮৫৭ জন যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে। এতে টিকেট বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার ৪২০ টাকা।
ঢাকাকে যানজট-মুক্ত করতে জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সরকার ২০১২ সালে মেট্রো-রেল প্রকল্প গ্রহণ করে। বাস্তবে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে।
১০ বছর কাজের পর ২২ কিলোমিটারের রুটের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার মেট্রো-রেল চালু হল।
যদিও এক বছর আগেই উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রো-রেল পরীক্ষামূলক চলাচল করেছে। শুরুতে প্রকল্পের আকার ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রসারণ, স্টেশন প্লাজা নির্মাণ, কিছু স্টেশনে নতুন করে জমি অধিগ্রহণসহ আরও নানা খাতে আরও প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে।