আল আমিন মুহাম্মাদ :
সিয়াম আর মমিন ওরা দুই বন্ধু। খুব ভালো একটা সম্পর্ক দুজনের মধ্যে। খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়া, ঘোরাঘুরি এক সঙ্গেই। প্রাইভেটও ওরা একই জায়গায় পড়ে এবং একসঙ্গেই বাড়ি থেকে যাওয়া-আসা করে। কোনো কোনোদিন মমিন আগে আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে সিয়ামের বাড়িতে ডাকতে যায়। আবার সিয়ামও কোনো কোনোদিন মমিনের বাড়িতে যায়। কিন্তু ওদের মধ্যে একটা জিনিসের পার্থক্য আছে। সিয়াম বড়লোকের ছেলে আর মমিন খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মমিনের বাবা নেই। গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। মমিনের বয়স তখন দেড় বছরের মতো। ওর মা ওকে অনেক কষ্টে লালন-পালন করে বড় করেছে। এখন সে ক্লাস ফাইভে পড়ে। সিয়ামদের বাড়িতে তার মা কাজ করে। দুবেলা খাওয়া আর মাস গেলে অল্প কিছু টাকা পায়। তাই দিয়েই কোনো মতে চলে ওদের সংসার। মায়ের অনেক স্বপ্ন ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে।
মনিনের ক্লাসে রোল নম্বর এক। আর সিয়ামের দুই। গরিব ঘরে সুযোগ-সুবিধা কম থাকার পরেও মমিন লেখাপড়া খুব মন দিয়ে করে। এজন্যই সে ক্লাসের ফার্স্টবয়। সিয়ামও খুব ভালো স্টুডেন্ট। মমিনের সাথে পাল্লা দিয়ে লেখাপড়া করে। আবার মন-মানসিকতাও খুব ভালো। মাঝে মাঝে মমিনকে খাতা-কলম দিয়ে সাহায্য করে। একসাথে টিফিনও খায়। সে যে গরিব, সিয়াম তা বোঝে। মনে মনে ভাবে, সিয়ামের বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো ওরা আর এরকম গরিব থাকতো না।
আজ মমিন আগে আগে সিয়ামকে প্রাইভেট পড়ার জন্য ওদের বাড়িতে ডাকতে গেল। সিয়ামের আজ একটু দেরি হলো। কারণ, সে তার ছোটকাকার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছে। তিনি ঢাকায় চাকরি করেন। সামনে ঈদ, সিয়ামের জন্য কি কি কিনতে হবে সে ব্যাপারে কথা বলছে। মমিনকে দেখে সিয়াম তার কাকাকে বলল, কাকা আমি এখন প্রাইভেট পড়তে যাবো। পরে কথা বলবো, ভালো থাকুন আপনি।
সিয়াম ও মমিন বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটছে। প্রায় দশ মিনিট লাগে স্যারের বাড়ি যেতে। মমিন সিয়ামকে প্রশ্ন করলো, মোবাইলে কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
আমার ছোটকাকার সঙ্গে। ফোন করে বলছিল যে, এই ঈদে তুই কি কি নিবি।
আমি বলেছি জামা, কালো চশমা আর ঘড়ি।
কথা বলতে বলতে ওরা কখন যেন পৌঁছে গেলো স্যারের বাড়ি।
কদিন পরেই ঈদ। কেনাকাটার ব্যস্ততা পড়ে গেছে। সিয়াম তার আব্বুর সঙ্গে আজ মার্কেটে গিয়ে নতুন কাপড়সহ অনেক কিছু কিনে আনলো। কিন্তু মমিনের সে কপাল নেই। অভাবের সংসার। বিধবা মায়ের স্বল্প রোজগারে কোনো রকম খাওয়া-দাওয়াটাই শুধু চলে। ঈদের মার্কেট করা ওদের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। ওরও মন চায় খুব, আসছে ঈদে নতুন জামা নেবে। মায়ের মনটাও খুব নাড়া দেয়, সন্তানের জন্য অন্য ছেলেদের মতো নতুন পোশাক কিনে দিতে, আরও কত কি। কিন্তু কিছুই করার নেই, আফসোস ছাড়া।
পরদিন সকালবেলা সিয়াম খুব খুশি মনে (ঈদের মার্কেট করে এসেছে বলে) একটু আগে আগে প্রাইভেট পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে মমিনদের বাড়িতে গেল। বাড়িতে ঢুকতেই ঘরের পেছন থেকে মমিনের কান্নাজড়ানো কথা শুনতে পেল। কেঁদে কেঁদে তার মাকে বলছে, এবার ঈদে নতুন জামা না দিলে আমি পড়তে যাবো না। আর ওর মা ওকে অনেক আশ্বাস দিয়ে বলছে, ঠিক আছে বাবা, ঈদের তো আরও কয়েকদিন বাকি আছে। সময় আসুক, তারপর দেখা যাবে। এর উত্তরে মমিন বলছে, না! না! না! তুমি এরকম বলে বলে শেষ পর্যন্ত দেও না। আগে বলো, কবে দেবে, তারপরে আমি পড়তে যাবো। তা না হলে যাবো না। মমিনের মা খুব মুশকিলে পড়ে গেলেন। কি যে করি! মা-ছেলের এই দুঃখজনক কাহিনির সব আড়াল থেকে সিয়াম শুনতে পেয়েছে। ওর কেমন যেন লাগছে! মমিনের প্রতি মায়া উপচে পড়ছে। তাই এক দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। বাড়ি গিয়ে তার আগের দিন মার্কেট করা জামাটা নিয়ে সোজা ফিরে আসলো মমিনের বাড়িতে। দেখলো মমিন কাঁদছে! সিয়াম নতুন জামাটা হাতে দিয়ে বলল, এই যে তোর নতুন জামা। আমারও যে সাইজ তোরও সেই সাইজ। খুব ভালো মানাবে জামাটা। এবার পড়তে চল। মমিন চোখটা মুছে বলল, না ভাই, আমি তোর জামা নিতে যাবো কেন! তুই তোর জন্য এবার ঈদে শখ করে কিনেছিস, তুই পরবি, আমি পরবো কেন?। সিয়াম ভালোবাসামাখা একটা ধমক দিয়ে বলল, আগে ধর, এই জামা! তারপর পড়তে চল। জোর করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এইটা তোর জামা। আর আমার জন্য আমার ছোটকাকা আরেক সেট বাড়ি আসার সময় নিয়ে আসবে। মমিনের মা এসব দেখে কেঁদে ফেলল। সিয়ামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, বাবা, আল্লাহ যেন তোর মঙ্গল করেন। মমিনও নতুন জামাটা পেয়ে খুব খুশি হলো। তারপর একসাথে আানন্দিত চিত্তে পড়তে গেল দুজন।