নিজস্ব প্রতিবেদক »
চট্টগ্রাম শহর এবং উপজেলাতে হঠাৎ বেড়েছে পাগলা কুকুরের উৎপাত। যাকে যেখানে পায়, সেখানে কামড়ে দিচ্ছে এসব পাগলা কুকুর। পাগলা এসব কুকুর নিয়ে আতংক সৃষ্টি হয়েছে নগরেও। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদ আলহাজ শওকত আল আমিন ওসমানী জানান, গত অক্টোবরে কুকুরের কামড়ে আহত ৫৪৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন জেনারেল হাসপাতালে। নভেম্বরে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন কুকুড়ের কামড় খেয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। কুকুরের কামড়ের জখমের ধরন অনুযায়ী দুটি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। তারমধ্যে এন্টি র্যাভিস ভ্যাকসিন (এআরভি) মজুদ রয়েছে। কিন্ত ইআরআইজি নামের ভ্যাকসিন একটিও হাসপাতালে মজুদ নেই। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের।
টিকা অপর্যাপ্তের বিষয় নিয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপোতে (সিএমএসডি) দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। সেখানে মজুদ রয়েছে। সেখানে গিয়ে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা যাবে।
এ ব্যাপারে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আগে কুকুর নিধনে কাজ করেছিলাম। এখন সেখানে বিধি নিষেধ রয়েছে। জনসচেতনতা তৈরিতে আমরা সব সময় কাজ করি। এটা সিটি কর্পোরেশনের একার কাজ নয়। সমষ্টিগত কাজ। সবাই মিলে কাজ করতে হবে। চসিক জনসচেতনতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বাকি কাজ কখন করবে। আপাতত কোনো পদক্ষেপ হাতে নেই। নিজ দায়িত্বেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কুকুর দেখলেই সাবধান থাকতে হবে।
সরেজমিনে গতকাল রোববার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কুকুরের কামড়ে আহত রোগীর উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য এতে কুকুর ছাড়াও বিড়াল, বানর, কাঠবিড়ালের কামড় খেয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন অনেক রোগী। তবে কুকুড়ের কামড় খেয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যাই বেশি।
রাহাত্তারপুলে মেসে থাকেন মোহাম্মদ পারভেজ আলম (৩৫)। তিনি নগরীতে রিকশা চালান। শনিবার চকবাজার প্যারেড কর্নারে দুই যাত্রীকে নামিয়ে দেয়ার সময় তাকে আচমকাই কুকুর কামড় দেয়। সারা রাত ব্যথা সহ্য করে গতকাল সকালে জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। ক্ষত ধুয়ে তাকে এআরভি ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়।
বৌ বাজারের বাসিন্দা ঝর্ণা বেগম (৫০)। গতকাল বিকালে হাঁটতে বের হয়ে কুকুড়ের কামড় খান। তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে আনা হয়। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত পড়ছিলো। জখম কম হওয়ায় এআরভি ভ্যাকসিন দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
হাসপাতালে কুকুরের কামড় খেয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যাটা বেড়েছে। সকাল বিকাল রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন হাসপাতালে। জখমের ধরন অনুযায়ী রোগীদের দুটি টিকা প্রদান করা হয়। সামান্য ক্ষত হলে, সেখান থেকে রক্ত পড়লে র্যাভিস ভ্যাকসিন। যেটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমানে আছে। অন্যদিকে ক্ষত বেশি হলে, একই সাথে বেশি রক্ত পড়লে ইআরআইজি ভ্যাকসিন। কিন্ত এটি হাসপাতালে একটি মজুদ নেই বলে জানান জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স দীপংকর রুদ্র।
তিনি আরও জানান , ইআরআইজি ভ্যাকসিন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাজারে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা বিক্রি হয়। বাইরে থেকে রোগীরা সংগ্রহ করে নিয়ে আসলে আমরা দিতে পারি। নি¤œবিত্তরা টিকা কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এদিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ড. সাদিয়া আহমেদ বলেন, কুকুড় কামড় দেওয়ার সাথে সাথে বাংলা সাবান দিয়ে ক্ষত স্থান ৩০ মিনিট ধরে ধুতে হবে। তারপর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। আক্রান্তদের আমরা তিনভাবে চিকিৎসা দিই।
ক্যাটাগরি-১ : যাদের কুকুর কেটেছে কিংবা শরীরের সাথে কুকুরের লেজের বাড়ি লেগেছে বা কুকুরের শরীরের কোনো লোমশ অংশ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের সংস্পর্শে এসেছে অথবা কুকুরকে খাওয়ানোর সময় শরীরে কুকুরের লালা লেগেছে কিন্তু কোনো ক্ষত এবং রক্তপাত হয়নি, কেবল তারাই ক্যাটাগরি-১ এর অর্ন্তভুক্ত। এ ধরনের রোগীর জলাতঙ্কের টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আক্রান্ত স্থান শুধু সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেললে কিংবা এন্টিসেপটিক দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করলেই হবে।
ক্যাটাগরি-২: যদি ক্ষতস্থানে কুকুরের আঁচড় বা কামড়ের দাগ দেখা যায় কিন্ত ক্ষতস্থান থেকে কোনো রক্তপাত না হয়, তাহলে তারা ক্যাটাগরি-২ এর অন্তর্গত। এসব আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্ষতস্থান পরিষ্কারের পাশাপাশি অবশ্যই জলাতঙ্কের টিকা নিতে হবে। জলাতঙ্কের এ টিকা চামড়ার নিচে কিংবা মাংসে দেওয়া যায়। কুকুর আঁচড় বা কামড় দেওয়ার ৫ দিনের মধ্যে এ টিকা নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। কুকুর দ্বারা আক্রান্ত গর্ভবতী নারীকেও এটি দেওয়া যাবে।
ক্যাটাগরি-৩: কুকুরের আঁচড় বা কামড়ে যদি রক্ত বের হয়, দাঁত বসিয়ে দেয় কিংবা মাংস কেটে নিয়ে গেলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্যাটাগরি-৩ এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। আবার ক্ষত যদি মাথা, গলা, বুক বা কাঁধে হয়; তবে সেটিও ক্যাটগরি-৩ এর অর্ন্তগত হবে। ক্যাটাগরি-৩ এর ক্ষেত্রে ক্ষতস্থান যথাযথভাবে পরিষ্কার এবং জলাতঙ্কের টিকার পাশাপাশি হিউম্যান র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশনও অবশ্যই দিতে হবে ।
শহরে যেহেতু কুকুরের কামড়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে তাই এখনি সচেতন হতে হবে। কোথাও বের হলে হাতে ভারী কিছু রাখতে হবে। শিশু এবং বৃদ্ধদের একা ছেড়ে না দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।