রাজিব শর্মা »
নগরে বেড়েছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। বাসার বদ্ধ ঘরে জমে থাকা গ্যাস, চুলা কিংবা গ্যাস লাইনের পাইপের ফুটো থেকে নির্গত গ্যাসে এবং বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অধিকাংশ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। ফলে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া সরকারি সেবা সংস্থার নজরদারির অভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও বাড়ছে। নগরে বড় কোন অগ্নিকা- বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনবলের সংকটে পড়বে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট ১৩৩টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এ দেড় মাসে আগুনের ঘটনায় মারা গেছেন ৫ জন।
গতবছরের ২০২২ সালের ৪ জুন শনিবার রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি কন্টেইনার ডিপোতে সবচেয়ে বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৪১ জন নিহত এবং ৪৫০ জনেরও বেশি আহত হন। সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরাসুল এলাকায় অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে এ ঘটনা ঘটেছে। এটি ছিল গত বছরের সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ড।
তাছাড়া ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫৯টি অগ্নিকা-ের ঘটনায় আহত হয়েছেন ২৫২ জন এবং মারা যান ৫৮ জন। ওই বছরে আগুনের ঘটনায় ২১ কোটি ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার ২৫০ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে বলে সুপ্রভাতকে জানায় এ প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগ।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নগরের ভবন ও মার্কেটগুলোর মধ্যে ৯৭ শতাংশ আগুনের ঝুঁকিতে আছে। ৯৩ শতাংশ বহুতল ভবনের কোনো রকম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। আইন থাকা সত্ত্বেও ৯৭ শতাংশ ভবনের জন্য ফায়ার সার্ভিসের বসবাসের উপযোগী ছাড়পত্র নেয়নি অনেক ভবন মালিক ও প্রতিষ্ঠান। বেশিরভাগ ভবন পুরোনো, সেখানে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সংযোজন করাও কঠিন। তাছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলেও আগুনের ঘটনা বাড়ছে।
তাছাড়া বহুতল ভবনের পরে নগরীতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বিভিন্ন বস্তি-কলোনি, মার্কেট, শপিং মল ও বিপণি বিতানগুলো। আগুনের ঝুঁকিতে থাকা নগরের ৪৩টি এই ধরনের জনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি তালিকা করেছে বলে সুপ্রভাতকে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মবিলাইজিং অফিসার মো. কফিল উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে নগরে যেসব অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ শটসার্কিট, গ্যাসের চুলা ও গ্যাস পাইপের লিকেজ ও বদ্ধ ঘরে জমে থাকা গ্যাস থেকে। বিশেষ করে শীতের সময় রান্নাঘরের দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় লিকেজ দিয়ে বের হওয়া গ্যাস ঘরে জমা হয়। ভোরে রান্না করতে গিয়ে কিংবা সিগারেট ধরাতে আগুন জ্বালাতেই মুহূর্তেই আগুন সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, আমাদের লোকবল সংকটও রয়েছে। নগরীর ৭০ লক্ষাধিক মানুষের জন্য মাত্র ৩৬০-৭০ জনের মতো দমকল বাহিনীর কর্মী রয়েছে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভূমিকম্প ও বড় কোনো অগ্নিকা-ের ঘটনায় জনবল সংকটে পড়তে হবে। তাছাড়া বর্তমান ফায়ার ফাইটারদের আধুনিক ট্রেনিংয়েরও প্রয়োজন আছে।
তিনি বলেন, অগ্নি নির্বাপণে আমাদের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে। কিন্তু যেসব গাড়ি রয়েছে তা নগরীর অলি-গলিতে কোন ঘটনা ঘটলে ঢুকানোর অবস্থা নেই।
ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, নষ্ট বৈদ্যুতিক তার এবং বোর্ড থেকেও দুর্ঘটনা ঘটছে। একটু সতর্ক হলেই অনেক অগ্নিকা-ের ঘটনা এড়ানো সম্ভব। দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে গ্যাসের চুলা নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং চুলার পাইপ এক বছর পরপর পরিবর্তন করা দরকার। বৈদ্যুতিক তার ও সুইচবোর্ড নষ্ট হলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এবং তিন বছর অন্তর পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের উপপরিচালক আবদুল হালিম বলেন, ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হিসেবে, নগরীতে প্রায় সাত হাজারের মতো বহুতল ভবন আছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভবন আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভবনগুলো সবচেয়ে বেশি আগুনের ঝুঁকিতে আছে। তাছাড়া একটি নগর অপরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রিত হলে এর জন্য বিভিন্ন ঘটনা বেড়ে যায়। যার দায় নগর পরিককল্পনাবিদরা এড়িয়ে যেতে পারেন না।’
তিনি জানান, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ অনুযায়ী ছয়তলার বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হলে তিন স্তরের অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর নিচে হলে দুই স্তরের অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। তবে এর আগে ফায়ার ফাইটিং পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবনের স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, ফায়ার লিফট, ফায়ার কমান্ড স্টেশন স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এরপর ফায়ার সার্ভিস সেখানে বসবাসের জন্য ছাড়পত্র দেবে।
ফায়ার সার্ভিসের লোকবল সংকট নিয়ে তিনি আরও বলেন, নগরের কালুরঘাট, আনোয়ারা, ইপিজেডসহ বেশ কয়েকটি ফায়ার স্টেশন হয়েছে। কর্ণফুলী টানেলকে কেন্দ্র করে আরো দুটি ফায়ার সাব স্টেশন হবে। কিন্তু সে অনুযায়ী আমাদের লোকবল সংকট রয়েছে। এখন হয়তো ঘটনাগুলোকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করছি। যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভূমিকম্পের মতো বড় কোন ঘটনা ঘটবে তখন হয়তো আমরা জনবল সংকটের মুখোমুখি হবো।
ফায়ার সার্ভিসের জরিপে দেখা গেছে, অগ্নিকা-ের বিপজ্জনক এলাকার মধ্যে রয়েছে নগরীর ১৮ মার্কেট ও এলাকা। এগুলো হচ্ছে রেয়াজউদ্দিন বাজার, পৌর জহুর হকার্স মার্কেট, পশ্চিম বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া, বউবাজার, মিয়া খান নগর, পাহাড়তলীর আমবাগান, শেরশাহ ও বার্মা কলোনি, বায়েজিদ থানার রৌফাবাদ, ইপিজেড থানার কলসী দীঘিরপাড়, ঘাট ফরহাদবেগ, খলিফাপট্টি, আতুরার ডিপো, বায়েজিদ থানার শান্তিনগর কলোনি, আসকার দীঘিরপাড়, ফিরিঙ্গীবাজার, হাজারী লেন প্রভৃতি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এর উপ নগর পরিকল্পনাবিদ ঈশা আনসারী বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস যদি মনে করে আমাদের পরিকল্পনায় ভুল আছে বা অগ্নিকা-ের ঘটনায় তাদের যেতে সমস্যা হচ্ছে এটি তাহলে তাদের ব্যর্থতা। কারণ আমরা তো পুরো নগরকে পরিবর্তন করতে পারি না। ইতালি, জাপানসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সরু গলির রাস্তা রয়েছে। সেখানের ফায়ার সার্ভিস কিভাবে আগুন নির্বাপণ করছে, তা ভাবতে হবে। আমাদের দেশের অবস্থান অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসকেও সেভাবে তৈরি হতে হবে।’