জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ
জলাধার ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে ভবন
নতুন করে প্রাকৃতিক জলাধার গড়তে হবে : বিশেষজ্ঞ মতামত
ভূঁইয়া নজরুল »
বগার বিল। বাকলিয়ার নিচু এলাকা। এই পুরো এলাকাটি প্রাকৃতিকভাবে সমগ্র বাকলিয়া এলাকার জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। কিন্তু গত এক দশক ধরে এখানে ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বাকলিয়া এক্সেস রোড নামে ৬০ ফুট চওড়া একটি রোড নির্মাণ করছে। এই রোডকে কেন্দ্র করে পুরো বগার বিলে এখন ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। যথারীতি বাকলিয়া এলাকার পানি নামতে না পেরে গত পাঁচদিন ধরে আটকে রয়েছে পানি।
শুধু বাকলিয়ার বগার বিল নয়। সিডিএ অক্সিজেন কুয়াইশ এলাকায় অনন্যা আবাসিক যে স্থানে গড়ে উঠেছে সেই এলাকাটি ছিল সমগ্র চান্দগাঁও এলাকার প্রাকৃতিক জলাধার। সে স্থানে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলায় এখন চান্দগাঁও ও অক্সিজেন এলাকায় বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। হালিশহরের ছোটোপুল, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ, হালিশহর কে ব্লক ও এল ব্লকসহ পুরো এলাকাটি এক সময়ের প্রাকৃতিক জলাধার থাকলেও এখন সেখানে হাজারো বহুতল ভবন। নগরীর প্রাকৃতিক পুকুর ও দীঘিগুলো অতি বৃষ্টির পানি ধারণের একটি ক্ষেত্র ছিল। কিন্তু সেসব পুকুর দীঘি ভরাট করে গড়ে তুলেছে স্থাপনা। নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি প্রকল্প চলমান থাকলেও নগরবাসী অতিবৃষ্টিতে এবং বৃষ্টি শেষ হবার তিনদিন পরও কেন পানিবন্দি থাকবে? কেন পানি নেমে যাবে না?
এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তিনটি প্রকল্প নয় আরো অসংখ্য প্রকল্প নিলেও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধান হবে না। হয়তো সাময়িকভাবে মনে হবে সমাধান হয়েছে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কোনো সুফল আসবে না।’
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে পানি ধারণের জায়গাগুলোতে আমরা আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছি। বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলছি। তাহলে পানি যাবে কোথায়?’
পানিকে প্রাকৃতিকভাবে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পশ্চিম দিকে আগে মাত্র একটি সড়ক ছিল পোর্ট কানেকটিং রোড। সেই রোডের পর পানি স্বাভাবিকভাবে সাগরে গিয়ে মিশে যেতো। কিন্তু সেই রোডের পর আমরা টোল রোড নির্মাণ করলাম। টোল রোডের পর আবারো এখন রিং রোড বানালাম। তাহলে বারবার পানির অবাধ চলাচলকে আমরা বাধাগ্রস্ত করছি। আর এভাবেই আমরা পানিবন্দি হয়ে পড়ছি।’
রফিকুল ইসলামের বক্তব্যকে সমর্থন করে বিশিষ্ট স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, ‘অনন্যা আবাসিক এলাকায় একটি ছয় তলার ভবন নির্মাণ করতে গেলে ১৫০ ফুট নিচ পর্যন্ত পাইলিং করতে হয়। তাহলে তা সহজেই অনুধাবনযোগ্য যে এই এলাকা ছিল প্রাকৃতিক জলাধার। সিডিএ সেখানে আবাসন প্রকল্প করে পুরো এলাকার পানি চলাচলে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং জলাবদ্ধতা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, এখন বগার বিল এলাকায় রাস্তা নির্মাণ করে পুরো এলাকাটি ভরাট করার প্রলুব্ধ করা হয়েছে এবং চলছে ভবন নির্মাণ। ফলে এই এলাকায় আগে যে পানি ধারণ করতো সেই পানিগুলো কোথায় যাবে? একইভাবে পুকুর ও দীঘিগুলো ভরাট করা হচ্ছে।
অনন্যা, কল্পলোক, বগারবিল ছাড়াও নগরীর রামপুর ওয়ার্ডের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একসময় বিশাল প্রাকৃতিক জলাধার ছিল। যেখানে দেওয়ানহাট, ঈদগাহ, মনসুরাবাদ, শান্তিবাগ, হালিশহর প্রভৃতি এলাকার পানি ধারণ হতো। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। ফলে এখন হালিশহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ জলবন্দি থাকছে। বিবিরহাট সুন্নিয়া মাদ্রাসা, ফরিদের পাড়া, শমসের পাড়া, আশেকানে আউলিয়া কলেজ ও হাজীপাড়ার মধ্যবর্তী বিশাল এলাকায় বর্ষাকালে পানি জমে থাকে। এখনো এই এলাকার একাংশ জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে এর বেশিরভাগ এলাকায় ভবন গড়ে উঠছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ জলাধারটিও হয়তো দখল হয়ে যাবে।
সমাধান কোথায়?
নগরীর যে সমস্যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? জলাবদ্ধতা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। এ বিষয়ে কথা হয় প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ্ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নালা ও খালের পাশাপাশি অতিরিক্ত পানি ধারণ করার জন্য অবশ্যই প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।’
তাদের প্রকল্পে জলাধার নির্মাণের বিষয়টি রাখা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনটি জলাধার নির্মাণের কথা প্রকল্পে রয়েছে। কিন্তু সিডিএ থেকে জায়গা অধিগ্রহণ করে দেয়া হলে জলাধার নির্মাণ করা যাবে।’
প্রাকৃতিক জলাধার ছাড়া অতিরিক্ত পানি ধারণের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ‘এ কাজটি সিডিএকে করতে হবে। কোন কোন এলাকায় প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণ করবে তা আগে থেকে নির্ধারণ করে সেই এলাকায় ঘরবাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া যাবে না।’
সিডিএ’র বক্তব্য
নতুন নতুন খাল খননের পাশাপাশি নালা ও খালের ব্যবস্থাপনা জরুরি উল্লেখ করে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘নগরীতে নতুন খাল খননের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। একইসাথে আমাদের বিদ্যমান নালা ও খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। নগর বর্জ্য ও পাহাড়ের বালি মাটির কারণে ভরাট হচ্ছে এসব নালা খাল। তাই নগর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করতে হবে।’
নগরীতে এখন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। এই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএ’র উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন,‘ একটি নগরীর জন্য অবশ্যই প্রাকৃতিক জলাধার থাকা প্রয়োজন। ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানে প্রাকৃতিক পুকুর ও দীঘি নিয়ে কিছু গাইড লাইন ছিল কিন্তু কোথাও সরাসরি সংরক্ষণের কথা বলা ছিল না। আমরা এবারের মাস্টারপ্ল্যানে তা কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় সেই বিষয়টিও উল্লেখ করবো।’
উল্লেখ্য, নগরীতে বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। পানি নেমে যাওয়ার জন্য যেসব নালা ও খাল রয়েছে সেগুলোও দখল। এতে পানি সহজে নামতে পারছে না। গত শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে টানা তিনদিন ভারী বর্ষণের পর গত সোমবার সকাল থেকে বৃষ্টি না হলেও নগরীর বাকলিয়াসহ অনেক এলাকা থেকে এখনো পানি নামেনি। ফলে মানুষ জলাবদ্ধতা দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে। এ সমস্যা সমাধার জন্য ৩৬টি খাল পুনরুদ্ধার ও ওয়াটার রিজার্ভার তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এছাড়া চাক্তাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত একটি প্রকল্প রয়েছে সিডিএ’র এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরও একটি প্রকল্প রয়েছে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য।