জিয়াবুল হক, টেকনাফ >>
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ৩১ জুলাই একবছর পূর্ণ হয়েছে। গেলো বছর কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর পুলিশি তল্লাশি চৌকিতে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এসআই লিয়াকত আলী তৎকালীন টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপের নির্দেশে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
সিনহা হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না তার মা-বোনেরা। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা নাসিমা আক্তার অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েনে। ঘরের প্রতিটি জায়গায় ছেলের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তিনি। তবে ছেলের বিভিন্ন সময়ের মানসিক শক্তি যোগানো কথাগুলো লালন করে সময় পার করেন। তিনি আশাবাদী দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। একই কথা সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ারের।
ভাইয়ের সাহসিকতার কথা তুলে ধরে শারমিন মুঠোফোনে বলেন, ‘এখন আমার ভাইয়ের হত্যার মামলা মোকাবিলা করছি। মনে হয় ও আমাদের সঙ্গে আছে, আমাদের সাহস ও শক্তি যোগাচ্ছে। ওর সবসময় পজিটিভ মনোভাব ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে ওর কথাগুলো মনে করে আমরা শক্তি পাচ্ছি। আমরা প্রতিটি মুহূর্তে ওকে মিস করছি। রাশেদের ক্ষত সারাজীবন আমাদের পরিবারকে বয়ে বেড়াতে হবে।’
বোন শারমিন শাহরিয়ার আরও বলেন, “কিছু ঠাণ্ডা মাথার খুনি পরিকল্পিতভাবে আমার মেধাবী ভাইটাকে হত্যা করেছে। হত্যার পর ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে নাটক সাজিয়েছিল। কিন্তু, সবার সহযোগিতায় সেটা পারেনি। দ্রুত সময়ে অভিযোগপত্র দেওয়ায় আমরা আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু, করোনার কারণে মামলার সাক্ষ্য নেওয়া যাচ্ছে না। ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। দ্রুত সাক্ষ্য নেওয়া জরুরি। কেননা, এসব সাক্ষীকে পরবর্তীকালে পাওয়া যাবে কি না, সেটা একটা ভয়। তবে, আমরা আশাবাদী আসামিরা যতই শক্তিশালী হোক, তাদের বিচার হবে।”
মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।
হত্যার পাঁচ দিনের মাথায় ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদি হয়ে টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে এবং ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি এবং মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে। এরপর মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। শুনানির পরে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর হয়। সেই থেকে তাঁরা এখনও কারাগারে রয়েছেন।
মামলার তদন্ত ও অভিযোগপত্র
আলোচিত সিনহা হত্যা মামলার পর হত্যার ঘটনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) স্থানীয় তিনজন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেফতার করে। পরে একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করে। এ ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর আলোচিত মামলাটি কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে র্যাব। অভিযোগপত্রে ১৫ জনকে আসামি করা হয় এবং অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডটিকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগপত্রে ৮৩ জনকে সাক্ষী করেন তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।
কারাগারে থাকা ১৫ আসামি হলেন, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল সাগর দেব ও রুবেল শর্মা ছাড়া ১২ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ ছাড়া এ ঘটনার সময় মেজর সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁরা যে নীলিমা বিচ রিসোর্টে ছিলেন, সেখানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূরকে আটক করে। পরে তাহসিন রিফাত নূরকে অভিভাবকের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শিপ্রা দেবনাথকে রামু থানায় করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। আর সিফাতকে টেকনাফ থানায় করা হত্যা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার দুটি মামলা ও রামু থানায় করা মাদকের মামলায় গ্রেফতর দেখায় পুলিশ। সিফাত, শিপ্রা ও তাহসিন বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। তাঁদের নিয়ে সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য কক্সবাজারে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কাজ করছিলেন।
পরবর্তীকালে, গত বছরের ৯ আগস্ট শিপ্রা ও ১০ আগস্ট সিফাতের জামিন মঞ্জুর করেন কক্সবাজারের আদালত। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। পরে ১৩ ডিসেম্বর এই দুই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) বিমান চন্দ্র কর্মকার রামু ও টেকনাফ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—পুলিশের করা দুই মাদক মামলায় শিপ্রার বিষয়ে অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
মামলার বর্তমান অবস্থা
চলতি বছরের ২৭ জুন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ মামলার অভিযোগ গঠন করার পর বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন। কিন্তু, করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ রোধে সরকারঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে হাইকোর্টের নির্দেশে সারা দেশের মতো কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ।
দ্রুত বিচার চায় পরিবার
টেকনাফে সিনহা হত্যার এক বছর