দেশে ঢুকছে ভারতীয় কাঁচামরিচ : আমদানি শুরু হওয়ায় কিছুটা কমেছে দাম

রাজিব শর্মা

দুর্গাপূজার ছুটি ও টানা বৃষ্টিকে ঘিরে গত এক সপ্তাহ ধরে অস্থির হয়ে উঠে কাঁচা মরিচের বাজার। তবে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে ভারত থেকে আমদানি শুরু হওয়ায় কিছুটা ফিরছে স্বস্তি। এছাড়া মাসের ব্যবধানে এখনো প্রায় দ্বিগুণ দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ভারতের বাজারের সঙ্গে দেশের বাজার হিসেবে অনেক বেশি দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।

দাম বাড়ার পেছনে খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন পাইকারদের। পাইকাররা দুষছেন আড়তদারদের। আর আড়তদারেরা দুষছেন শুল্ক বন্দর দিয়ে আমদানি করা মধ্যস্বত্ব কারবারিদের।

গত শনিবার রেয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারি আড়তে যে মরিচ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, একই মানের মরিচ গতকাল মঙ্গলবার ১৪০ থেকে ১৪০ টাকায় নেমে আসে। আর খুচরা বাজার বকসিরহাটে গত সপ্তাহে একই কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছিল ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় তা গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজিতে। তবে এসব কাঁচামরিচ গত এক মাস আগেও বিক্রি হিেছল ৩০ থেকে ৪৫ টাকায়। যা ব্যবধানে তিনগুণের বেশি। এদিকে দাম কিছুটা কমায় ব্যবসায়ীরা আপাতত ‘স্বস্তি ফিরেছে’ মনে করলেও ক্রেতারা জানান, ‘এখনো অনেক বাড়তি। বাজার তদারকির বিকল্প নেই।’

গতকাল রিয়াজুদ্দিন বাজারের সবজি কিনতে আসা শিক্ষিকা পারভিন আক্তার বলেন, ‘এ- মনতিই সবজির দাম অনেক বেশি। সেই সুযোগে বৃষ্টির ইস্যু তোলে কাঁচামরিচের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। যে কাঁচা মরিচ আমরা একমাস আগেও ৪০ টাকায় কেজিতে কিনেছি, একই কাঁচামরিচ এখন ২০০ টাকা।

বকসিরহাটের খুচরা বিক্রেতা মো. রুবেল বলেন, ‘কাঁচা মরিচের দাম বেশি রেয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তে। তারা আমাদের গত সপ্তাহেও ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এখন আমাদের সব খরচ সম্বনয় করে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

রেয়াজউদ্দিন বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. ফারুক বলেন, ‘গত সপ্তাহ থেকে কাঁচা মরিচের দাম বাড়তি । আমাদের বিক্রি করতে হয়েছে ২০০ টাকা করে । আজকে দাম কিছুটা কমেছে। ‘
‘দেশীয় চাষের কাঁচামরিচ বাজারে নেই’

জানা যায়, চলতি মওসুমে অতিমাত্রায় খরার কারণে মরিচের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশে উৎপাদিত কাঁচা মরিচের সরবরাহ কমে গেছে, যার কারণে গত দুই সপ্তাহ ধরে বাড়তির দিকে কাঁচামরিচের বাজার। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য মতে, ‘বর্তমানে দেশীয় চাষের কোন কাঁচামরিচ বাজারে নেই।’

রেয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শিবলী ফারুক বলেন, ‘দেশীয় চাষের কোন মরিচ বাজারে নেই। গত সপ্তাহে ভারতের স্থলপথ সীমান্ত বন্ধ থাকায় মরিচ সরবরাহ হয়নি। এছাড়া পচনশীল সবজি মরিচকে কোল্ড স্টোরেজে রাখারও সুযোগ নেই। ‘আড়তদারেরা দাম বাড়াচ্ছে’ বলে খুচরা ব্যবসায়ীরা যেসব অভিযোগ তুলছে তা অনেকটা মিথ্যে। মূলত কৃত্রিম সংকট হওয়ায় দাম বেড়েছে । তবে এখন রেয়াজউদ্দিন বাজারের আড়তে ভারতীয় কাঁচা মরিচ আসছে। মঙ্গলবার থেকে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে যা গত সপ্তাহে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

ভারতের বাজারে কাঁচামরিচের দাম কেমন, কেনই বা ৪০ টাকার মরিচ এখন ১৪০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, যখন দেশি কাঁচামরিচ ছিল তখন আমরা অনেক সস্তায় কিনেছি। তখন আমরা সস্তায় বিক্রি করেছি। এখন আমদানির দরের ওপর নির্ভর। এ বিষয়ে আমদানিকারকরা ভালো জানবে। আমরা তাদের থেকে নিয়েই বিক্রি করি।’

মধ্যস্বত্ত্বকারবারিরা নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার
এদিকে আমদানিকারকরা বলছেন, টানা আট দিন আমদানি বন্ধ থাকায় দেশে কাঁচা মরিচের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আমদানি বাড়লে দাম আরও কমে আসবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন। তবে বেনাপোলের আমদানিকারকরা অভিযোগ করেন, বন্দর থেকে ৮০ টাকা কেজিতে মরিচ ছাড় পেলেও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারসাজির কারণে দেশের বাজারে দাম অনেক বেড়ে যায়। তারা বাজার মনিটরিং জোরদার করার দাবি জানান।

হিলির কাঁচা মরিচ আমদানিকারক শাহরিয়ার ইসলাম বলেন, “শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে টানা ছয় দিন আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকায় হিলিসহ আশপাশের বাজারে কাঁচামরিচের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০ টাকায়। তবে শনিবার থেকে আমদানি পুনরায় শুরু হওয়ায় দাম কমতে শুরু করেছে। এসব কাঁচামরিচ ভারতের উত্তর প্রদেশ, মধ্যে প্রদেশ, বিহার রাজ্যসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে আমদানি হচ্ছে। দেশে কাঁচামরিচ না থাকায় আমাদের আমদানি নির্ভর হতে হচ্ছে।’

আমদানিকারক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ভারত থেকে কাঁচামরিচ আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে সুবিধা দিলেও সে সুবিধা ক্রেতা পর্যায়ে পর্যন্ত যাচ্ছে না। যেমন আমরা কাঁচা মরিচ বিক্রি করলাম ১০০ টাকা, সেটি স্থানীয় বাজারে ৩০০ টাকা। এই তিনগুণ বাড়ার পেছলে শক্তিশালী হাত থাকে মধ্যস্বত্ত্বকারবারীদের।’

ভারতের বাজারে যে দামে বিক্রি হয়েছে কাঁচামরিচ
দেশীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আমদানিকারকরা যতই দাম কমতির গল্প শুনাচ্ছে, কিন্তু ভারতের বাজারে কাঁচামরিচের দর তার চেয়ে অনেক কম। আমদানি বুকিং রেট, শুল্কসহ হিসেব করলে দেশি পর্যায়ে কাঁচামরিচের দর ১০০ টাকার নিচে থাকার কথা।

গত এক সপ্তাহ ধরে কাঁচামরিচ জাত ও মানভেদে ভারতের কাঁচা মরিচের মাস্তিগুলোতে পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে প্রতি কুইন্টালে ২ হাজার ৬৭৫ থেকে ৩ হাজার ৮০০ রুপি পর্যন্ত। গত সপ্তাহ থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত, গুজরাটের মরিচ ৩৫ থেকে ৪০ রুপি (৫০-৬০ টাকা), মহারাষ্ট্রের মরিচ ৩৩ থেকে ৩৮ রুপি (৪৭ থেকে ৫৭ টাকা), কর্ণাটকের মরিচ ৪২ থেকে ৪৮ রুপি (৬০ থেকে ৬৮ টাকা), তামিলনাড়ু র মরিচ ৫৫ থেকে ৭০ রুপি (৭৮ থেকে ১০০ টাকা), অন্ধ্র প্রদেশের মরিচ ৩৫ থেকে ৫২ রুপি (৬৪ থেকে ৬৫ টাকা), পশ্চিমবঙ্গের মরিচ ৪০ থেকে ৫০ রুপি (৫০ থেকে ৭২ টাকা) দরে বিক্রি করেছে রপ্তানিকারকরা। যা গড়ে হিসেবে করলে কেজি প্রতি ৪৪ রুপি অর্থাৎ ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা। এছাড়া এসব মরিচের দরের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের শুল্ক ছাড়সহ সব হিসেব করলে দাম হবে প্রায় ৮০ টাকার নিচে। কাজেই ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে মরিচ বিক্রি করেছেন দেশীয় ব্যবসায়ীরা।

২৩৭ টন কাঁচামরিচ আমদানি
হিলি কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন জানান, হিলি স্থল বন্দর দিয়ে গেলো শনি ও রোববার দুই দিনে ভারতীয় ২৪ ট্রাকে ২৩৭ মেট্রিক টন ৫০০ কেজি কাঁচামরিচের আমদানি হয়েছে। পণ্যটি পচনশীল দ্রব্য হওয়ায় বন্দরে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য পণ্য থেকে আমরা এটাকে আলাদা ভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকি, যত দ্রুত সম্ভব শুল্কায়ন কার্যক্রম শেষে পণ্যটি ছাড়করন করে থাকি। যাতে করে ব্যবসায়ীরা পণ্যটি দ্রুত সরবরাহ করতে পারে।