এম. আতহার নূর »
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছেÑ‘‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” এছাড়াও ২৮ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী, পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না’’। উল্লেখিত ২টি অনুচ্ছেদ ছাড়াও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে আরো অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেখানে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ সকল প্রকার প্রতিবন্ধী- অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে। এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন দ্বারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার স্বীকৃত রয়েছে। প্রত্যেক সচেতন সুনাগরিকের অধিকার একটি বৈষম্যহীন ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রে বাস করার, যেখানে সবার জন্য নিজস্ব অধিকার চর্চার অনুকূল পরিবেশ থাকবে। সব মানুষের সহযোগিতায় একটি সুন্দর বাসযোগ্য প্রতিবন্ধীবান্ধব রাষ্ট্র গড়বে।
আমাদের দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দৃষ্টিহীনতায় নিদারুণ জীবন যাপন করছে। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১০ লাখ ব্যক্তি দৃষ্টিহীনতায় ভুগছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী, যারা শারীরিকভাবে পূর্ণ সুস্থ-সবল মানুষ; কেবল দৃষ্টিহীনতার কারণে তাদের স্বাভাবিক সুন্দর ছাত্রজীবন ব্যাহত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত তারা পরিবারের, সমাজের তথা রাষ্ট্রের বোঝায় পরিগণিত হচ্ছে। যদিও বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা দ্বারা দৃষ্টিহীনতা নিবারণ সহজ হয়েছে। যেমন আন্তর্জাতিক অন্ধ কল্যাণ সংস্থা সাইট সেভার্সের সহযোগিতায় মিরপুরস্থ ‘ঢাকা চক্ষু হাসপাতাল’ এক যুগান্তকারী অনবদ্য সৃষ্টি, যেখানে বিনামূল্যে উন্নতমানের অস্ত্রোপচার দ্বারা বিপুলসংখ্যক দরিদ্র চক্ষু রোগীর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য চিকিৎসা করা হচ্ছে। কিন্তু জন্মগত অন্ধ ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি চিকিৎসার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।
প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা ডিসেম্বর, ১৯৯৫ ( ন্যাশনাল পলিসি ফর দ্যা ডিসঅ্যাবলড ১৯৯৫) ও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ (বাংলাদেশ ডিসঅ্যাবেলিটি ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট ২০০১) গৃহীত সমন্বিত আইনগুলো প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক সুযোগ-সুবিধা অনুচ্ছেদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র ও সিদ্ধান্তসমূহে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও সম-অধিকার নিশ্চিতকরণের ১৪ টি নীতি, বিবৃতি সরকার রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ১. শিক্ষা ২. স্বাস্থ্য ৩. গবেষণা ৪. তথ্য ৫.সহায়ক উপকরণ ৬.কর্মসংস্থান ৭.মুক্ত চলাচল ও যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধা ৮. চিত্তবিনোদন। এছাড়া প্রতিবন্ধীদের ৬টি শ্রেণিতে ভাগ করে তাদের জন্যে মৌলিক অধিকারসহ মানবীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ সুযোগÑসুবিধা প্রদান আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় আমাদের দেশে এখনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হাজারো মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী অবহেলিত, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে তাদের সাজানো স্বপ্নগুলো। মোট প্রতিবন্ধীদের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি চাকরি পাচ্ছে।এছাড়া আধুনিক ব্রেইল পদ্ধতির বইয়ের পর্যাপ্ত অভাব দেশে বিরাজমান। চাকরি পরীক্ষাতে শ্রুতিলেখকের অনুমতি নামের বিড়ম্বনা সহ হাজারো সংকীর্ণতায় জর্জরিত হচ্ছে তারা। প্রত্যেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী একজন যোদ্ধা। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে, শত বাঁধা উপেক্ষা করে তারা শিক্ষা গ্রহণ করছে। এমন ছাত্র বেশিরভাগই তার নিজের হল খরচ, হাত খরচ এবং লেখা-পড়ার খরচ পুরোটা নিজেই ব্যবস্থা করে। কারণ তাদের পরিবারও যথেষ্ট সচ্ছল নয়। তারপরেও এই যোদ্ধারা থেমে থাকে না। তাদের গহীন হৃদয় জুড়ে একটিই প্রত্যাশা যেন সংবিধানের কোন আইন স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা না হয়, বরং হোক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিবন্ধকতা জয়ের পথে সহায়ক। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এমন দরিদ্র দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি রয়েছে নানা ধরনের আর্থসামাজিক প্রতিকূলতা। কিন্ত সব বাধা ও প্রতিকূলতা জয় করে তারা সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, একটি সুন্দর ও সার্থক জীবন গড়ার যুদ্ধে থাকে। বহির্বিশ্বের দেশগুলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দক্ষ জনশক্তি রূপে প্রস্তুত করছে দেশের স্বার্থেই। তাদের দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে উন্নত বিশ্বের আমেরিকা, জাপান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, লন্ডন, চীন, ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে তাদের অবাধ বিচরণের পরিবেশ তৈরি করেছে যাতে তারা সৃষ্টিগত অপূর্ণতাকে কাটিয়ে তুলতে পারে। যেমন, ভারতের বোম্বাই শহরে রয়েছে দৃষ্টিহীনদের জন্য যাদুঘর। জার্মানে রয়েছে দৃষ্টিহীন ছাত্রদের জন্যে অনলাইন প্রযুক্তির বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগের নিদর্শন ‘স্মার্টবাস অ্যাপ’ যার দ্বারা সহজে তারা নিজ বাড়িতে পৌঁছাতে পারবে।
তুরস্কে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যে ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অনেকেরই শারীরিক কিছু সমস্যা থাকে, যেগুলো এই ফিজিওথেরাপির মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব ভারতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি শেখানো হয় হাতের কাজও, শিক্ষার্থীরা অনেক আগ্রহ নিয়ে এসব কাজ শেখেন।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীরা বরাবরই বঞ্চিত। বেশির ভাগ প্রতিবন্ধীই খুব দারিদ্রের মধ্যে জীবনযাপন করে। শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার পরও মনের জোরে অনেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। অথচ সেই শিক্ষিত প্রতিবন্ধীরা ঠিকমতো চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তারাও তো দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রাখতে পারে। ১৯৯৬ সালে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ না পেয়ে হাইকোর্টে রিট দাখিল করেন এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সংবিধানে রক্ষিত সমান অধিকার আদায়ের জন্য সেটি ছিল কোনো প্রতিবন্ধীর প্রথম মামলা। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের কোটা-সংক্রান্ত কোনো বিধান না থাকায় সে মামলা খারিজ হয়। অন্যদিকে ভারতে ২০০৭ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে এক অন্ধ শিক্ষার্থী আবেদন করলেও অন্ধ বলে তাঁকে নিয়োগ দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভারতের উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলার রায় আসে বাদির পক্ষে। একই বছর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭০ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। উচ্চ আদালতের রায়ের ফলে ভারতের প্রতিটি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটির (সিআরআইডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবন্ধীদের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যে সিংহভাগ শহুরে মানুষ। বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্যে পাঠদান সহজলভ্য করে তুলতে হবে ব্রেইল পদ্ধতিতে সকল বইয়ের সাথে পর্যাপ্ত প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে হবে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি চাকরিতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়োগ দিতে হবে। সমস্ত চাকরি পরীক্ষাতে শ্রুতিলেখক অবিলম্বে নীতিমালা কার্যকর করতে হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্নাতক ডিগ্রিধারীদের জন্যে অন্তত চাকরির আগ পর্যন্ত মাসিক ১০ হাজার টাকা করে বেকার ভাতার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শিক্ষা নীতিমালা-২০০৯ এর যথাযথ বাস্তবায়ন করা দরকার। উন্নত বিশ্বের দেশের ন্যায়, বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক