সাধন সরকার »
২৭ সেপ্টেম্বর ছিল ‘বিশ^ নদী দিবস’। এ বছর স্থানীয়ভাবে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘দূষণমুক্ত নদী সুস্থ জীবন’। নদীর জীবন আছে। জীবন আছে বলেই এই নদী আমাদের সেচ ব্যবস্থা, যাতায়াত, মৎস্য উৎপাদন, পানি সরবরাহ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। সময়ের পরিক্রমায় নদীর প্রাকৃতিক গঠনগত পরিবর্তন, কম পানি প্রাপ্তি, দখল, দূষণ আর ভরাটের কারণে দেশের নদ-নদীর অবস্থা বেহাল। দখল-দূষণের সাথে পলিচাপা পড়ে দম বন্ধ হয়ে নদীগুলো মারা যাচ্ছে! দেশের কোনো কোনো নদী শেষ চিহ্নটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে! পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আজ সবখানে।
উন্নত বিশ^ যখন চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে তখনও আমাদের জানা নেই যে, আমাদের দেশে আসলে নদীর সংখ্যা কত ? এ ব্যাপারে সরকারি বিভিন্ন বই ও প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। এসব ভিন্ন ভিন্ন তথ্য মূলত নদী রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিকতার অভাবকেই তুলে ধরে! কোনো কোনো নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে আছে, অথচ বাস্তবে নেই! অনেকের লোভ-লালসার ছাপ পড়েছে নদীর ওপর। নদী দখল করে অনেকে মাছ চাষ করছেন, বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে নদীর ওপর, নদীর জমি দখল করে অনেকে নেতা বনে যাচ্ছে, আবার অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যরে লাইন জুড়ে দিয়েছে নদীর সাথে। অনেক স্থানে গৃহস্থালির বর্জ্যরে লাইনও জুড়ে দেওয়া হয়েছে নদীর সাথে। আবার কোনো কোনো স্থানে শহরের সিটি করপোরেশনের ময়লা-আবর্জনা গিয়ে পড়ছে পাশের নদীতে। শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। নদ-নদী দূষণ-দখল আর ভরাটের সাথে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী! বিভিন্ন সময় তারা দলের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নদ-নদীগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে! নদী দখল-দূষণকারীরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে না। তারা অবোধের মতো প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে মেতে উঠেছে।
নদীও কথা বলে, নদীরও সুখ-দুঃখ আছে। যুগের পর যুগ নদ-নদীগুলো আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রেখেছে। নদীগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ করে চলেছে। নদীতে বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে একটার পর একটা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ছোট-ছোট খাল-বিল, শাখানদী, উপনদীগুলো ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হচ্ছে। ফলে বড় বড় নদ-নদীতে পানি সরবরাহের উৎসে এখন টান পড়েছে। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, নদীগুলো আমাদের সম্পদ, সৌন্দর্য। নদ-নদীর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। আমরা যদি চোখ বন্ধ করে বিশ বছর আগে এলাকার বা স্থানীয় নদ-নদীর কথা চিন্তা করি তাহলে কি নদ-নদীর এমন মরণদশার চিত্র দেখতে পাব ? নিশ্চয় না।
গত দুই-তিন দশকে নদী-নদীগুলো তাদের প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে! সরকার বছরের পর বছর নদ-নদী বাঁচাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সেসব অর্থের যথার্থ ব্যবহার হয়নি! সময়মতো নদীগুলো খনন করা হয়নি। আর হলেও নদী খনন কাজে দক্ষতার অভাবে নদ-নদীগুলোর পলি অপসারণ করার পরপরই নদ-নদীগুলো আবার ভরাট হয়ে গেছে। পলি অপসারণ করেই ওই মাটি নদীর তীরেই রাখা হয়েছে, ফলে সেই মাটি নদীতেই আবার এসে পড়েছে। এভাবে বছরের পর বছর নদীতে পলি ও বালু পড়ে ডুবোচরের সংখ্যা বেড়েছে। নদী খনন কাজে জবাবদিহি ও পরিকল্পনার অভাবে নদ-নদীগুলোর আজ এমন বেহাল দশা। তথ্য মতে, এখন দেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ২৩০টির মতো। নৌপথ ক্রমাগত কমতে কমতে এখন নেমে এসেছে চার হাজার কিলোমিটারে (যদিও পানির মৌসুমে নৌপথ দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার!)। অথচ ব্রিটিশ শাসনামলে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১৪ হাজার। পাকিস্তানি আমলে নৌপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার।
আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে নৌপথের সুবিধা অনেক। নৌপথে পরিবহন খরচ কম, জ¦ালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। কোনো কোনো সময় নদীর জমি অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ বা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় নদীর তীরের জমি বেদখল হয়ে হাতছাড়া হয়ে গেছে। নদীর ওপর এমনসব অত্যাচার চলতে থাকলে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশের বদলে ‘নদীমৃত্যুর দেশে’ পরিণত হবে! আগে বাংলাদেশে নদী রক্ষায় এত এত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছিল না, অথচ তখন নদ-নদীর দখল-দূষণ-ভরাট কম হতো। আর এখন নদী রক্ষায় বহু প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও নদ-নদীগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না!
সম্প্রতি হাইকোর্ট এক রায়ে দেশের নদ-নদী রক্ষায় কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছে। রাজধানীর তুরাগ নদকে ‘লিগ্যাল পারসন, জুরিসটিক পারসন ও জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে হাইকোর্ট বলেছে, নদী দখলকারীরা সব ধরনের নির্বাচনের অযোগ্য হবেন, তাঁরা ঋণও পাবেন না। এটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ে আরও বলা হয়েছে, একজন মানুষের যেমন আইনগত অধিকারের সুযোগ আছে, তেমনি নদ-নদীর সে ধরনের অধিকার আছে। হাইকোর্ট ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে নদ-নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছে। তাই সময় এসেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরও লোকবল, সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজনীয় স্বাধীন ক্ষমতা দেওয়ার।
এ ছাড়া নদী বিষয়ে আলাদা ট্রাইব্যুনাল করলে তা নদ-নদী রক্ষার্থে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। নদী পুলিশও গঠন করা যেতে পারে। সম্প্রতি সরকার নদ-নদী দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। এখন থেকে নদী দখল-দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন কিছু নয়। নদ-নদী তথা প্রকৃতির উপর বছরের পর বছর অত্যাচার করে কোনো সভ্যতা টিকেনি। তাই আমাদের সম্পদ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নদ-নদীগুলোকে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এক একটি নদী এক একটি পর্যটন ক্ষেত্রও বটে। পর্যটনের এ সম্ভাবনার দ্বার যত বেশি সুস্থ থাকবে নদ-নদী রক্ষাসহ পর্যটনের বিকাশ তত ত্বরান্বিত হবে। নদ-নদী রক্ষার্থে দেশের যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ছাড়া দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে নদ-নদী গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ রক্ষক হিসেবে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। প্রত্যেকটি নদীর রক্ষায় স্থানীয় জনগণকেও নদীর সব ধরনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি এলাকার জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ সাংসদরা নিজ নিজ এলাকার নদী রক্ষার দায়িত্ব আরও গুরুত্বের সাথে বুঝে নেন। এক একটি নদী রক্ষার ভার একেকজন সংসদ সদস্যের হাতে থাকলে ওই নদী দখল-দূষণ আর ভরাট করতে কেউ সাহস পাবে না। এ ছাড়া কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে আর নদী দখল করতে পারবে না। সর্বোপরি, নদীর দখল-দূষণ রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : পরিবেশকর্মী