নিজস্ব প্রতিবেদক »
আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে একসাথে ছুটছিল তিনটি মোটরসাইকেল। জিইসি লুপের অংশে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। ব্যস্ত ফ্লাইওভারে পাশ ঘেঁষে মোটরসাইকেল পার্কিং। নেমেই শুরু হয় ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। পাশ কেটে যাচ্ছে বড়-ছোট গাড়ি। এতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারোর। এমন ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইওভারে গাড়ি পার্কিং করে কেন ছবি তুলছেন? কোথাও কি লেখা আছে ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা নিষেধ? প্রশ্নের এমন জবাব দিলেন সাহেদ।
ঠিকই তো কোথাও নেই ফ্লাইওভারের ব্যবহারবিধি। গাড়ি চলাচল শুরু করার বেশ কিছু বছর কেটে গেলেও প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়া ফ্লাইওভারের নিয়মবিধি দেওয়া হয়নি। ফ্লাইওভার আছে, কিন্তু কেন নিয়মবিধি দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ শেষ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে তারা দেখবেন।’
‘ফ্লাইওভারের কাঠামো করেছে সিডিএ তারাই তো ব্যবহারবিধি দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা দেয়নি। জানালেন চট্টগ্রাম সিটি করপেরেশন নির্বাহী প্রকৌশলী আবু ছিদ্দিক।
কিন্তু সিডিএ এবং চসিকের এমন পাল্টাপাল্টি জবাবের সমাধান কী?
ফ্লাইওভার দেখাশুনার কর্তৃপক্ষ যারা তারা এ কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ। তিনি বলেন, ‘ফ্লাইওভার ব্যবহারবিধি বিষয়ে আলাপ করে দেখবো।’
ব্যস্ত নগরে যাতায়াতে দুর্ভোগ কমাতে দ্রুত গতির যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য তৈরি করা হয়েছে চারটি ফ্লাইওভার। ব্যবহারকারীরা ফ্লাইওভার ব্যবহারের নির্দেশনা বা সতর্কতা আছে কি না তা জানে না। যার ফলে ঘটে যাচ্ছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।
তথ্যসূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে ৯২৭ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছে চারটি ফ্লাইওভার। চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়েছে বহদ্দারহাট এম এ মান্নান ফ্লাইওভার। ১ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার এ ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় ১৪৭ কোটি টাকা। একই বছরে খুলে দেওয়া হয় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের দেওয়ান হাট ওভারপাস। এরপর এক কিলোমিটার দীর্ঘ ৫৮ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি কদমতলী জংশনের ফ্লাইওভার খুলে দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর। সর্বশেষ প্রায় ৬৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি দীর্ঘ ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটারের আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার খুলে দেওয়া হয় ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে। বর্তমানে ২০২১ সাল শেষের পথে, এতগুলো বছর অতিবাহিত হলেও এসব ফ্লাইওভারে লাগানো হয়নি সতর্কমূলক নির্দেশনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার ব্যতীত বাকি তিনটির সামনে নামফলকই নেই। ট্রাফিক সাইনের ব্যবহার দেখা গেলেও এতে নেই ফ্লাইওভারের ব্যবহারবিধি। না জেনেই অনেকে বিকেলে সময় কাটাতে বেঁচে নিয়েছে ফ্লাইওভার। কেউ হাঁটছেন। কেউ মোটরসাইকেল বা কার থামিয়ে আড্ডায় মশগুল। কেউবা ছবি তুলছেন।
দেওয়ানহাট ওভারপাসে যাত্রী নিয়ে রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। ফ্লাইওভারে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ এ বিষয়ে জানেন না রিকশাচালক কামাল। ওভারপাস থেকে নামার পর তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘ফ্লাইওভার গাড়ি চলাচলের জন্য তৈরি হয়েছে। তাই আমার গাড়িও চলছে।’ আবার কেউ কেউ রেলিংয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছেন।
কদমতলী ফ্লাইওভারে হাঁটাহাটি করতে দেখা যায় উদ্বাস্তু মানুষজনকে। অনেক রিকশাচালকও যাত্রী নিয়ে ফ্লাইওভারের উপরে দাঁড়িয়ে।
আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে উঠতেই দেখা মিলে ভিন্ন চিত্রের। খণ্ড খণ্ড স্থানে মোটরসাইকেল ও কার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু যুবক যুবতী। কেউ গাড়িতে বসে বেশ আড্ডা জমাচ্ছেন। কেউ ফ্লাইওভারের মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। এমনিভাবে গত ২৫ সেপ্টেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় এই ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল দাঁড় করে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় গাড়ির ধাক্কায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। জিইসি অংশে যেতেই ফ্লাইওভারের লুপ বেয়ে উঠতে দেখা যায় কিছু মানুষকে। লুপের আশপাশের অংশ খানিকটা চওড়া হওয়াতে তারা সেখানে বসছেন। বিশেষ করে বিকেলের সময়ে এমন চিত্রের দেখা মিলে। মেয়রগলির সামনে থেকে উঠা সরু লুপেও দুই পাশের ফ্লাইওভার দেখতে দাঁড়িয়ে থাকে অনেক মোটরসাইকেল আরোহী।
এতেই শেষ নয়, মেয়রগলির দিক থেকে উঠা লুপে বহদ্দারহাটের দিকে যাওয়ার কোনো রাস্তা না থাকায় উল্টো পথে আসতে দেখা যায় বেশ কয়েকজন মোটরসাইকেল আরোহীকে। এমন উল্টো পথে গিয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ট্রাকের ধাক্কায় অন্য একজনের মৃত্যু হয়েছে এই ফ্লাইওভারে।
নকশা যখন হয় তখনই সবকিছুর একটি লেআউট থাকার কথা। কিভাবে এটি ব্যবহার হবে। কিভাবে নির্মাণ করা হবে সবই। এসব বিষয়ে বলছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘কোনো ধরনের পরিবহন ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে পারবে, কারা পারবে না, কায়িক শ্রমের বাহন চলাচল নিষিদ্ধ, হাঁটা নিষেধ, উল্টো পথে যাওয়া নিষেধ, কত উচ্চতার গাড়ি চলবে, কতটুকু ওজনের গাড়ি চলতে পারবে, কোন ধরনের গাড়ি চলবে এসব নির্দেশনা ফ্লাইওভারের প্রবেশ মুখে দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া কোনো রাস্তা কোথায় নামছে, কোন রাস্তা কত দূরত্বে আছে সবই রোড মার্কিয়ে থাকার কথা। শুধু সাইনবোর্ডে লিখলে হবে না, ছবি দিয়ে বুঝাতে হবে। কারণ অনেকে পড়তে জানে না। তারা ছবি দেখে বুঝে নিতে পারবে।’সচেতন মহল বলছেন, ফ্লাইওভার তৈরির পর খুলে দেওয়ার আগেই প্রবেশমুখে ব্যবহারবিধি কিংবা নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড লাগানো প্রয়োজন ছিল। এমন নির্দেশনার সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকলে অনেকেই মানতো। কিন্তু নির্দেশনা না থাকার কারণে কেউ জানেও না, মানেও না। আবার যারা জানে তাদের অনীহা আছে প্রতিপালনে। এসব কারণে ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে বলে ধারণা তাদের।
ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী বাসের ড্রাইভার হারুন সিকদার বলেন, ‘নির্মাণের পর থেকে চলাচলে প্রতিনিয়ত ফ্লাইওভার ব্যবহার করছি। তবে ফ্লাইওভারে বিভিন্ন অংশে আড্ডা জমানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো মূল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। তারাই এক্সিডেন্ট করে মারা যায়।’
আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হয়। ফ্লাইওভারে দাঁড়ানোর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জানেন না বলে জানান অনিক বড়ুয়া। আদনান শরিফ বলছেন, ‘ফ্লাইওভারে দাঁড়ানো নিষেধাজ্ঞা বিশ^ব্যাপী। কিন্তু এখানে কোথাও লেখা নেই। এসব না দেওয়া কারণে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না।’