মোহীত উল আলম »
সঞ্চয়িতা গ্রন্থে সংগৃহীত চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অনুকূলে ছাপানো “দুই বিঘা জমি” কবিতাটির শেষে এর রচনার তারিখ দেখানো হচ্ছে ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০২। ইংরেজিতে বর্ষ হয় ১৮৯৫, যখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ৩৪। সে সময়ে তিনি প্রতি স্তবকে বারো পংক্তি করে মোট ছয় স্তবকে ৭২ পংক্তির চমৎকার সমিলে (“ঋণে/কিনে” ইত্যাদি) রচনা করলেন এই কবিতাটি, যেটি আমার মতে বাংলা সাহিত্যের একটি অনুপম সম্পদ।
রবীন্দ্রনাথের ৮৩তম মহাপ্রয়াণ বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করতে গিয়ে এই কবিতাটি বিশেষভাবে আমার মনে উঠে এলো এর অতিÑআশ্চর্য সাম্প্রতিকতায়। বলা যায়, মানুষের অর্থনৈতিক সমাজের একটি চিরভাস্বর রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটিতে। একটি সম্পদহরণের বা সম্পদ হারানোর গল্প এটি। উপেন নামক একজন সাধারণ গৃহস্থের জমি, দুই বিঘা জমি, কীভাবে বাবু/রাজা/জমিদার তাঁর ক্ষমতাবলে হরণ করে নিলেন, এরই মর্মান্তিক বর্ণনা এ কবিতাটি। কিন্তু এর তলায় তলায় বিধৃত হয়ে আছে মানবসমাজের শোষণপ্রক্রিয়ার দীর্ঘ এবং প্রায় অমোচনীয় একটি প্রকরণ। শেক্সপিয়ার তাঁর পেরিক্লিস নাটকে মাৎসন্যায়-যুক্ত একটি সংলাপ রেখেছেন, যেটির উল্লেখ করে রবীন্দনাথের “দুই বিঘা জমি”-র প্রসঙ্গে আসতে চাই। ঐ নাটকটিতে তৃতীয় জেলে প্রথম জেলেকে জিজ্ঞেস করছে, আমি চিন্তা করি, মাছেরা সমুদ্রে বেঁচে থাকে কীভাবে? তখন প্রথম জেলে উত্তর দেয়, কেন, মানুষ যেভাবে বাঁচে, বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলে: ‘দ্য গ্রেট ওয়ানস ইট আপ দ্য লিটল ওয়ানস’।
শেক্সপিয়ারের বড় মাছ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় হচ্ছে বাবু, জমিদার বা রাজা, আর শেক্সপিয়ারের ছোট মাছ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় হচ্ছে ঘটনার বর্ণনাকারী ‘উপেন’। সবিশেষ উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি সর্বাংশে একটি যুগপৎ আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সমাজচিন্তার আকর। সে সম্পর্কটাই বিশ্লেষণ করা এই রচনার মূল উদ্দেশ্য। উপেনের জমিতো জমিদার কোন সংগত কারণ ছাড়া দখল করতে পারেন না। একটাতো যুক্তি দরকার। যুক্তিটা বলছেন: “বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা, / পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা।” কিন্তু জমিদার এখানে থেমে গেলেন কি? না। একটা হাইফেনের পর অর্থাৎ একটু থামার পর জমিদার বলছেন, “ওটা দিতে হবে।”
“ওটা দিতে হবে,” এই শব্দগুচ্ছকে সহজেই বাংলাদেশের ভূমিদস্যুদের অপ্রতিহত অগ্রাভিযানের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূলে আছে ভূমিদস্যুদের অব্যাহত দখলদারীত্ব, ধানের জমি খেকো, নদী খেকো, পাহাড়খেকো, এমনকি সমুদ্রখেকো পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথের জমিদারের ন্যায় এই ভূমিদস্যুরা ভূমির আদি মালিকদের হটানোর সময় তাদের ওজর-আপত্তি শোনার পর চোখ লাল করে ক্ষণকাল মৌন থেকে “শেষে ক্রুর হাসি হেসে” বলে, “আচ্ছা, সে দেখা যাবে।”
এই “দেখা যাবে”র মাজেজা হলো উপেনের মাস দেড়েকের মধ্যে সপ্তপুরুষের পৈতৃক ভিটা থেকে উচ্ছেদ এবং মুসাফির হয়ে যাওয়া: “পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে।” প্রায় আমাদের কোটি কোটি দরীদ্র লোকের, ভাসমান জনগোষ্ঠীর ভূমি-ছেঁড়া জীবনেতিহাসের ‘এম আর আই’ রিপোর্ট যেন এটা।
আর জমিদারের যুক্তি যে তিনি “বাগানখানা” প্রশস্ত করবেন তাই তাঁর উদ্বৃত্ত জমি দরকার সামান্য হেরফের করে বলা যায় এটি একটি আদর্শগত কথন যেটির মর্মমূলে আছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। একটি মহৎ আদর্শের যখন পণ্যের পর্যায়ে অবনমন হয়, তখন এর একটি অর্থনৈতিক উপযোগিতার সৃষ্টি হয়, তখন ঐ আদর্শকে বারবার এর নিহিত মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়ে কপচানো বা বুলি আওড়ানো হচ্ছে শাসকমহলের এর একটি রাজনৈতিক কৌশল যাতে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যটা চাপা পড়ে যায়। এই উপাত্তটি সম্প্রতি কোটা-সংক্রান্ত ঘটনাবলীর জন্য প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযুদ্ধের মহৎ আদর্শকে যদি তেপ্পান্ন বছর পরেও বংশানুক্রমিক সুবিধা হিসেবে প্রাপ্তিযোগ্য মনে করা হয়, তা হলে বলতে হবে, ঐ আদর্শকে অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ, আদর্শের বুলি আওড়ে একটি বৈষয়িক সুবিধাপ্রাপ্তির কালান্তরিত সুযোগ তৈরির রাস্তা হচ্ছিলো, যেটি উচ্চ আদালতের সময়োচিত রায়ের ফলে রহিত হয়ে গেছে। সমাজবিদ আন্তোনিও গ্রামসি সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে সমাজের কর্তৃত্বকারী মহল নানান রাজনৈতিক অভীপ্সায় আদর্শের ভাবমূর্তির হেরফের ঘটায়। অর্থাৎ, জমিদারের “বাগানখানা” উত্তরাধুনিক রাজনৈতিক সমাজের প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত নানান আদর্শেরই নামান্তর মাত্র।
রবীন্দ্রনাথ যখন এই কবিতাটি লেখেন, তাঁর উল্লেখিত জমিদার তাঁরই আপন দর্পন কিনা সেটা আমরা জানি না, কিন্তু তিনি তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কর্তৃক পূর্ববঙ্গে তাঁদের বিশাল জমিদারী দেখভাল করার দায়িত্ব পান ১৮৯০ সালে। এবং এটি লর্ড কর্নওয়ালিশের ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন পাশ হবার প্রায় একশ বছর পরের ঘটনা। কাজেই কবিতায় কথিত জমিদার রবীন্দ্রনাথ নিজে হোক বা না হোক, কিন্তু জমিদারদের অহংকারের মূল ভিত্তি যে ঐ কালাকানুনটি সেটি অবশ্যই স্বীকার্য। একটি কালাকানুন যে কীভাবে শোষণ ও বঞ্চনার রাস্তা তৈরি করে তারই কাব্যিক দৃষ্টান্ত “দুই বিঘা জমি” কবিতাটি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি রচনার একান্ন বছর আগে, ১৮৪৪ সালে কার্ল মার্ক্স একটি বিশিষ্ট প্রবন্ধ লেখেন, ইংরেজি অনুবাদে যেটার শিরোনাম, “দ্য পাওয়ার অব মানি ইন বুর্জোয়া সোসাইটি,” যেখানে এক জায়গায় তিনি শেক্সপিয়ারের নাটক “টাইমন অব এথেন্স”-এর ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে নাটকটিতে টাকার প্রকৃত ধর্ম উন্মোচিত হয়েছে। টাইমন খুব ধনী অবস্থা থেকে হঠাৎ ভাগ্যবিড়ম্বিত অবস্থায় পতিত হয়ে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে থাকলে একদিন হঠাৎ স্বর্ণের গুপ্তধন আবিস্কার করেন। তখন একটি দীর্ঘ উক্তিতে স্বর্ণের (মার্ক্সের ভাষায় টাকা) মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, স্বর্ণ কালোকে সাদা, কুৎসিতকে সুন্দর, ভুলকে শুদ্ধ (“ব্ল্যাক ওয়াইট, ফাউল ফেয়ার, রং রাইট”)-এ পরিণত করতে পারে। অর্থাৎ টাকার প্রভাবে মানুষ এমন ক্ষমতা অর্জন করে যে সে তার চরিত্রের বিপরীত গুণাবলী বা পণ্যের ওপরও নিজের অধিকার আরোপ করতে পারে।
মার্ক্সের এই তত্ত্বটির ইংরেজি শব্দগুচ্ছ হলো ‘এ্যালিনিয়েটেড এবিলিটি’ বা, বাংলায় বলি, বিচ্ছিন্নকৃত সক্ষমতা। রবীন্দ্রনাথ প্রধানত ছিলেন সামন্তবাদী যুগের পরিবেশে লালিত, তারপরও বুর্জোয়া সংস্কৃতির চেতনা তাঁর মধ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে, কাজেই তাঁর চিত্রিত জমিদারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে মার্ক্স কথিত পুঁজি বা টাকার জোর বা প্রভাব খাটিয়ে উপেনের জমিকে নিজের বলে গলাধকরণ করা। এটা জমিদারের বিচ্ছিন্নকৃত সক্ষমতা। রবীন্দ্রনাথের জমিদারের স্থলে আমাদের নব্যধনীদের, যাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের মাধ্যমে দেশান্তর করেছে বলে খবর হয়েছে, তাদেরকে বসাই, আমরা একই চিত্র পাবো। যে কোনদিন হোটেল ব্যবসার ‘হো’ ও জানে না, সে অকাতরে পাঁচ তারকা হোটেলের মালিক হয়ে যাচ্ছে, যে কোনদিন ষাঁড় এবং গাভীর মধ্যে তফাৎ ভালোমতো বুঝতে পারে না, সে হয় গরু-ছাগলের খামারের মালিক, যেখানে ছাগলের দাম হাঁকানো হয় পনের লক্ষ টাকা।
এই কবিতার প্রেক্ষাপটে বিষয়-চেতনায় মার্ক্সের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি মিল আছে। ভারতের চাণক্য, ইউরোপের ম্যাকিয়াভেল্লী, কার্ল মার্ক্স, মিশেল ফুকো, বা আমেরিকার স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট এঁরা সবাই সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন বস্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। মার্ক্সের শ্রেণি সংগ্রামের ব্যাখ্যাই হলো যে বস্তর উৎপাদন-প্রক্রিয়ার উপাদান এবং উপাত্তগুলোর মালিকানা যে শ্রেণির হাতে থাকে তারাই অপর শ্রেণিকে বা প্রলেতারিয়েৎদের শোষণ করে। অর্থাৎ, বস্ত যার করায়ত্ত তার পক্ষে শাসন ও শোষণ বজায় রাখা সম্ভব। সে অর্থে ‘টাকা তুমি কার?’ প্রবচনের মতো বলা যায় ‘বস্ত তুমি কার?’
এই চিন্তা থেকে বলছি, রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমি”-র জমিটা আসলে একটি বস্ত বা সম্পদ, যার বিনিময় মূল্য আছে। যদিও বাংলার অপরূপ প্রকৃতি উপেনের ভাষায় “নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি” এবং উপেন যতোই বলুক, “সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া, / দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!” আসলে জীবন চলে বিষয়গত দিক থেকে অবধারিত হয়ে, সেখানে উপেনের দেশপ্রেম,“জননী বঙ্গভূমি,” বা ভিটা প্রেম, বা আমাদের কোটা প্রেম বা অন্যান্য আদর্শগুলোও চরম পরীক্ষার মুখোমুখি হয়, যখন সেটি বিষয়স্পৃষ্ট হয়। তখন উপেন সখেদে যতোই “ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি, / যখনি যাহার তখনি তাহারÑএই কি জননী তুমি!” উচ্চারণ করুক না কেন, এই সত্যটাই রবীন্দ্রনাথ একটি বক্রোক্তির মাধ্যমে উপস্থিত করেছেন যে, হ্যাঁ, এইটাই সত্য: “জননী বঙ্গভূমি” পয়সার আবেশে “দেবী” থেকে “দাসী”-তে পরিণত হয়ে সুখ লাভ করতে পারে। এইটিই মার্ক্স কথিত এ্যালিনিয়েটেড এবিলিটি। এখানেই মার্ক্সের সমাজচিন্তার সাথে রবীন্দ্রনাথের সমগোত্রীয় চিন্তার মিল।
এই চিন্তাটিকে আরেকটু সম্প্রসারিত রাজনৈতিক পরিভাষায় বলা যায়, উপেনের ‘দুই বিঘা জমি’-র ন্যায় তৎকালীন ’পূর্ব-পাকিস্তান’ নামক ভূ-খন্ডের ওপর পাকিস্তান তাদের দখলদারীত্ব বজায় রাখতে চেয়েছিলো বলেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ’-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, এবং বাংলাদেশ আমরা পেলাম। উপেনের অসাহয়ত্বের জায়গায় বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে বলীয়ান করলেন, এবং আমরা আমাদের ভূ-খন্ড তথা প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে পারলাম।
বৈষয়িক জগতের সঙ্গে ভাবাদর্শ জগতের সংঘাত, এবং এর ফলে বৈষয়িক জগতের (টাকা, ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি, এবং সর্বপোরি একটি চলমান রাজনৈতিক রিটারিক) বিজয়ের করুণ আখ্যান বিধৃত হয়েছে কবিতটির শেষ স্তবকে। উপেন দেশের মায়া কাটাতে না পেরে “বছর পনেরো-ষোল” পরে এককালের নিজ পৈতৃক ভিটায় ফিরে এসে গাছ থেকে ঝরে পড়া দুটি পাকা আম কোঁচড়গত করলে বাগানের মালী তাকে ধরে নিয়ে জমিদারের সামনে হাজির করে। জমিদার তাকে জেরা করে চোর হিসেবে সাব্যস্ত করেন: “বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।” তখন উপেনের সঙ্গে আমরাও কাঁদতে শুরু করলাম: “আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে– / তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।”
খুব অলক্ষ্যে হলেও বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনীতিক-অর্থনীতিক প্রেক্ষাপটে উপেনের শেষ উচ্চারণটি বেশ ক্রিয়াশীল।