সাতকানিয়া পৌরসভা
নিজস্ব প্রতিবেদক
সাতকানিয়া পৌরসভার দুই সরকারি কর্মকর্তার ব্যাংক হিসেবে গত ২-৩ বছরে প্রায় ৮ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই দুজন কর্মকর্তা হলেন- সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত দাশ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এএইচএম আলমগীর। ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক, সাতকানিয়া কেরানিহাট শাখায় দুজনের যৌথ এবং একটি পৃথক হিসাব নম্বরে লেনদেনের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বেতনভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা হয়ে দুজনের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি দুদক খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপপরিচালক লুৎফুল কবির চন্দন জানান, সাতকানিয়া পৌরসভার দুই কর্মকর্তা ব্যাংক হিসেবে অন্তত সাড়ে সাত কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে দুদক।
সূত্রটি জানায়, দুজনের যৌথ হিসেবে লেনদেন হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এএইচএম আলমগীরের একক ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকার বেশি।
অভিযোগ আছে, সরকারি পদে চাকরির আড়ালে এ দুজন কর্মকর্তা ঠিকাদারি ব্যবসাও করেন। নামে-বেনামে তাদের রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পৌরসভার নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। ঠিকাদাররা এ দুজনের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেননি মেয়র। ফলে তারা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
দুদক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ‘নকশাকারক’ হিসেবে সাতকানিয়া পৌরসভায় যোগ দেন বিশ্বজিত দাশ। ২০১২ সালে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী প্রকৌশলী হন। পরে তাকে চকরিয়ায় পদায়ন করা হয়। চকরিয়া থেকে বদলি হন বান্দরবানের লামা উপজেলায়। ২০১২ সালের শেষে তিনি পুনরায় সাতকানিয়া পৌরসভায় বদলি হয়ে চলে আসেন। ২০০৬ সাল থেকে একই পৌরসভায় কর্মরত আছেন হিসেবরক্ষণ কর্মকর্তা এএইচএম আলমগীর।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক কেরানীহাট শাখায় যৌথ হিসাব খোলেন প্রকৌশলী বিশ্বজিত দাশ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আলমগীর। যার নম্বর ০০৫৮-০৩২০০০১২৯০। হিসাব খোলার দু’দিন পর ৩১ জানুয়ারি ওই অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা। যৌথ হিসাবটিতে প্রতিমাসে লেনদেন হয়েছে ৫ লাখ থেকে ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত। যৌথ হিসাব নম্বরে ২০১৮ সালে ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা জমা হয়েছে। দেখা গেছে, ২০১৮ সালে ২৯ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত যৌথ হিসাবে লেনদেন হয়েছে মোট ৩ কোটি ২৮ লাভ ৯৪ হাজার ৮১৭ টাকা।
এর আগে ২০০৯ সালের ২৯ অক্টোবর একই শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এএইচএম আলমগীর। যার নম্বর ০০৫৮-০৩১০০০৯৫২৪। এ হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১২ সালে ২৯ অক্টোবর থেকে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে কয়েক লাখ টাকা। ২০১৬ সালে ১ বছরে জমা হয়েছে (১ লাখ টাকার বেশি) প্রায় ২১ লাখ টাকার বেশি। ১ হাজার থেকে ৯৯ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা হয়েছে কয়েক লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৮ সালে তার ব্যাংক জমা হয় ৭৪ লাখ টাকার বেশি। টাকার অংকে ১ হাজার থেকে ৯৯ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা হয়েছে আরও কয়েক লাখ টাকা। ২০১৯ সালে মোট টাকা জমা হয়েছে প্রায় ৯৮ লাখ টাকা। টাকার অংকে ১ হাজার থেকে ৯৯ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা হয়েছে কয়েক লাখ টাকা। ২০২০ সালে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে মোট ৫৮ লাখ টাকার বেশি। গত ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একই হিসাব নম্বরে মোট লেনদেন হয়েছে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫৮ হাজার ৪৯২ টাকা।
এ ব্যাপারে টিআইবির চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তার কবির চৌধুরী বলেন, ‘যেদেশে ড্রাইভার যদি কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক হন, তাহলে একজন সহকারী প্রকৌশলী ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন করা কোন বিষয় না। বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুনামির মত হরিলুট চলছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। এ কারণেই এ অবস্থা হচ্ছে। যে যার মতো করে দুর্নীতি করছে। দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে আমাদের সরকারি আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত দপ্তরগুলো।’
বক্তব্য নিতে গতকাল বুধবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুজনের মোবাইল ফোনে একাধিক বার কল করা হলেও রিসিভ করেননি তারা। এছাড়া দু’জনের মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।