হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
সমস্ত তা’রীফ ও প্রশংসা তাঁরই জন্য, যে আল্লাহ্ তাআলা তামাম সৃষ্টিজগতের ¯্রষ্টা, রিয্কদাতা, পালনকর্তা। তাঁর পবিত্রতা ও কৃতজ্ঞতা জানাই, যিনি আমাদের রিযকের উৎস এ মাটিতে দিয়েছেন উর্বরতা, যার কারণে উৎগত শস্যÑফসল আমরা আহরণ করি। তিনি আমাদের এ গুলোকে প্রক্রিয়াজাত করার উপায়, উদ্ভাবনের কলাÑকৌশল শিখিয়েছেন।
একমাত্র উপাস্য সেই আল্লাহ্, যিনি আমাদের প্রয়োজনে আগুন, পানি, আলো, বাতাস সবকিছুর যোগান দিয়েছেন। তাঁর প্রভুত্বে কারো অংশীদারিত্ব নেই। উপাস্য শুধু তিনিই। আমাদের বিবেককে শাণিত করে তাঁর কুদরত বুঝে তাঁর প্রতি ঈমান আনার জন্য তিনি নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, তাও তাঁর অসীম অনুগ্রহ। ইমামুল আম্বিয়া, সায়্যিদুল মুরসালীন, রহমতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহরই বান্দা ও তাঁর রাসুল। এ বিশ্বাসের ওপর আল্লাহ্ আমাদের জীবন মরণ কবুল করুন।
প্রতি মুহূর্তে আমরা আল্লাহ্র যত নেয়ামত ভোগ করে থাকি, আমরা তার কণা পরিমাণ কৃতজ্ঞতা ও প্রকাশ করি না। আমরা আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আমাদের চতুর্পাশে তাঁর অসংখ্য অগণিত নেয়ামতের মাঝে ডুবে আছি। মাছ যেরূপ পানির মধ্যে ডুবে বাঁচে, সেই রূপ। আল্লাহ্ তাআলার ফরমান, ‘যদি তোমরা আল্লাহ্র নেয়ামত গণনা কর, তবে গুনে শেষ করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে মানুষ অনাচারী, অকৃতজ্ঞ’। (সুরা ইবরাহীম : ৩৪) অন্য আয়াতে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্ তাআলার ইরশাদ, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তবে তোমাদেরকে (নেয়ামত) আরো দেবো। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিঃসন্দেহে আমার শাস্তিও মর্মন্তুদ’। (১৪:৭) আমাদের আপাদ-মস্তক, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রত্যেকটি এক একটি নেয়ামতের স্মারক, যা বিকলাঙ্গ কোন মানুষের প্রতি দৃষ্টি দিলেই আমরা বুঝতে পারি। বুঝতে পারি যে, তিনি কত মহিমাময় ও অনুগ্রহশীল প্রভু। পবিত্র কুরআনুল কারীমে কত মমতা নিয়ে তিনি প্রিয় সৃষ্টিকে জানিয়েছেন তাঁর অপরিসীম অনুগ্রহের কথা, ‘হে মানব, তোমাকে তোমার করুণাময় পালনকর্তার বিষয়ে কিসে বিভ্রান্ত করলো? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাকে যথাযথ বিন্যস্ত করেছেন। তদুপরি প্রতি অঙ্গে সমতা রক্ষা করেছেন। আর তিনি নিজ ইচ্ছানুযায়ী আকৃতি অবয়বে তোমাকে সুগঠিত করেছেন। (৮২:৬-৮)
কদাচ কিছু বিকলাঙ্গ মানব শিশু জন্মাতে দেখা গেলে তাও বাকীদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে, তিনি চাইলে তোমাকেও তাÑই করতে সক্ষম। তাই মনে রাখা উচিৎ, আমাদের এ অস্তিত্ব আমাদের ফরমায়েশ ও পছন্দ মতে করা হয়নি, বরং সবটা একান্তই সৃষ্টিকর্তার পছন্দমতেই হয়েছে। এটা স্মর্তব্য যে, যিনি করুণা পরবশ আমাকে নিজ ইচ্ছাতে সৃষ্টি করেছেন, আমার অস্তিত্বের ওপর তাঁর দাবি, অধিকার আমার নিজের চেয়েও অধিক। কারণ, আমি তো সৃষ্টিই হয়েছি শুধু তাঁর ইচ্ছায়, নিজের ইচ্ছায় নিশ্চয় নয়। তারপরও তিনি ইহজীবনে আমাদেরকে নিজ পছন্দে চলার স্বাধীনতা দিয়েছেন, যা দিতে সেই প্রভু বাধ্যও নন। পাশাপাশি তিনি আমাদের জন্য জীবনবিধানও দিয়ে দিয়েছেন। আবার তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে, তাও বারংবার বলে দিয়েছেন, বলে দিয়েছেন ইহজীবনে কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশের কথাও।
মায়ার পৃথিবীতে মিছে মরীচিকার পেছনেই তো সবাই প্রতিযোগিতা দিয়ে ছুটছি ক্রমশঃ। ভুলে থাকি, এগুলো ফেলে রেখে আমাকে বিদায়ও নিতে হবে, হিসাবের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেও হবে। এতসব জানার পরেও যারা দুনিয়ার মোহে পড়ে, ক্ষণিক জীবনের সুখভোগের জন্য সম্পদ গড়ার নেশায় হারাম-হালাল, ভাল-মন্দ কিছুরই পরোয়া করে না, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। সম্পদের পাহাড় গড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সুখের পায়রা ধরার জন্য মরীচিকার পেছনে দৌঁড়ছে, এই দৌঁড়ের গতি শ্লথ হয়ে আসতেই তাদের আর ভোগের অবকাশ থাকে না। নানা উপসর্গ বাসা বাঁধে নধর দেহে। চিকিৎসক তাঁকে উপদেশ দেন, এবার রসনা সংযত করুন। তার চে’ পরিকল্পনা এটাই ভাল যে, পরযাত্রা যখন নিশ্চিতই, তা হলে সে স্থায়ী জীবন পরকালে একটা সুখের আশ্রয় উভয়জগতের মালিক, প্রভু আল্লাহ্র কাছ থেকে প্রাপ্তির কোন উপায় করি। আল্লাহ্র নির্দেশনা হল, ‘আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করে নাও, নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হল তাকওয়া বা খোদাভীতি’। বাস্তবিকই যাঁরা মনেÑপ্রাণে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্কে ভয় করে চলতে পারেন, তাঁদের অন্তরে আর কারো ভয়Ñভীতি থাকে না। পক্ষান্তরে, যারা শুধু পার্থিব দুনিয়ার লোভে অন্ধ হয়ে শুধু এটাই অর্জনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, তারা হয়তো পার্থিব সম্পদের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ হন; কিন্তু স্থায়ী পরকাল তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। যারা এখানে ধনী, সেখানে কাঙ্গাল, তারাই তো পোড়া কপাল। আয়াতান্তরে মহান আল্লাহর ইরশাদ, ‘অনেকেই বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, ‘আমাদেরকে এ দুনিয়াতে দান করো’-তার জন্য থাকে না পরকালের কোন অংশ। আর তাদের মধ্যে কারো কারো প্রার্থনার ভাষা হয়, ‘হে আমাদের লালন-পালনকারী, আমাদেরকে দুনিয়াতেও দাও কল্যাণ-সমৃদ্ধি, আখেরাতেও দান করো প্রাচুর্য-সৌন্দর্য। আর জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদেরকে রক্ষা করো’। (বাক্বারাহ : ২০০-২০১) আখেরাতের ফসলের জন্য ক্ষেত্র এ দুনিয়া, তাই এখানে থাকতেই গোছাতে হবে আমাদের নিজ নিজ আখের।
এ জগতে আমাদের কাটাতে হবে মুসাফিরের মত। গন্তব্য আমাদের এখানে নয়, আখেরাতে। এ পৃথিবীর মায়াবী জৌলুশ দুর্বল করে দেয় আমাদের মন-মানসিকতা। এ কাজের জন্য অদৃশ্য এক শত্রু আমাদের পেছনে লেগে আছে জোঁকের মত। সে অভিশপ্ত শয়তান। শত্রুটি বন্ধুর সম্ভাষণে সারাক্ষণ আমাদেরকে দেয় কুমন্ত্রণা, দেয় প্রলোভনের প্ররোচনা। এখানেই প্রাপ্তি নিয়ে নিতে প্রলুব্ধ করে। আল্লাহ্, রাহমান ও রাহীম আমাদেরকে তাঁর পবিত্র বাণীতে সচকিত করে বলেন, ‘এ দুনিয়ার জীবন তো নিছক খেল-তামাশা বৈ কিছু নয়। আর নিঃসন্দেহে, আখেরাতের নিবাসই তো সত্যিকার জীবন, যদি তারা জানত’। (৩০:৬৪) পার্থিব এ জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। ভাবতে হবে, এ জীবনের স্থিতি দম ফেলার পরিমাণ। কারণ, পরবর্তী শ্বাস গ্রহণের অনুমোদন তাঁরই ইচ্ছাধীন। তৈরির সময় এখনই। সাধকÑস¤্রাট আরেফ রুমী (রহ.)’র মসনভী শরীফে উক্ত একটি ছোট্ট কাহিনী দিয়েই শেষ করা হবে আজকের আলোচনা। আল্লাহ্ যেন আমাদেরকে প্রবৃত্তির সাথে বোঝাপড়ার ক্ষমতা দান করেন।
‘এক দেশে অভিনব এক প্রথা জারি ছিল। বছর শেষ হলে তারা সাগর তীরে জমায়েত হোত। জাহাজ থেকে যে ব্যক্তি তাদের উপকূলে প্রথম পা রাখত, তাকে তারা এক বছরের জন্য রাজারূপে বরণ করত। বছর শেষে আবার তাকে রাজ সিংহাসন থেকে বরখাস্ত করত। অতঃপর তাকে এক নির্জনদ্বীপে নির্বাসনে রেখে আসত। সেই জনহীন তেপান্তরে তাকে ধুঁকে মরতে হত। তারা ওই নিয়মে অপর এক রাজাকে সিংহাসনে বসাত। এক বছর, সেখানে এল এক সুচতুর বুদ্ধিমান রাজা। দেশের লোকেরা তাকে রাজা বানাল। রাজা বিচক্ষণতার সাথে তাদের এ নিয়মনীতি জেনে নিল। সে বলল, ‘তোমার কথামতে আমি তোমাদের রাজা। তাই, আমার সব কথা তোমাদের মানতেই হবে। ‘তারা সবাই বলল, ‘নিশ্চয়, তোমার নির্দেশ আমাদের শিরোধার্য’।
রাজা এবার জনহীন ওই বিরান দ্বীপকে আবাদ করার পরিকল্পনা নিলেন। সে অনুযায়ী রাজা শাহী ফরমান জারি করলেন। সহ¯্র শ্রমিক-কারিগর ওই দ্বীপে পাঠিয়ে দিলেন। পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে সেখানে রাজমহল, মন্ত্রী-অমাত্যের জন্য সুরম্য অট্টালিকা, সু-শোভিত উদ্যান কানন, বাগান-ঝর্ণা ইত্যাদি বানিয়ে নিলেন। প্রশস্ত রাস্তাঘাট, গাড়ি-ঘোড়াসহ শহুরে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি দ্রুতগতিতে সরবরাহ করে এক বছরের মধ্যে সেই দ্বীপকে এক সুসজ্জিত, সুশোভিত মনোরম উন্নত নগরে রূপান্তরিত করে নিলেন। কোলাহল মুখর চাকচিক্যময় সুন্দর সভ্যতার রূপে ঢাকা পড়ে গেল সেই নির্বাসন দ্বীপের আতঙ্কময় রূপ। তাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না।
এদিকে বছর না ঘুরতে রাজার আর তর সইছিল না, কখন বছর ফুরাবে, কখন তিনি সেই দ্বীপটিতে যাত্রা করবেন। অবশেষে সে দেশের নিয়মানুযায়ী তারা রাজাকে পদচ্যুত করে নির্ধারিত দ্বীপে নিয়ে গেল। রাজা সেখানে পৌঁছলে, সেখানে আগেই পাঠানো তাঁর মন্ত্রী-অমাত্য, পাত্র-মিত্রা, সৈন্য-সামন্ত, প্রহরী-ভৃত্য, দাসী-বাঁদীসহ সবাই এসে তাঁকে রাজকীয় অভ্যর্থনায় বরণ করে নিল। (সংক্ষেপিত)
ঈমানদারের কাছে নিশ্চয় দুনিয়ার সুখভোগ হতে আখেরাতের নেয়ামতই উত্তম। আল্লাহ্র ঘোষণা, ‘যে পরকালের ফসল চায়, আমি তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালে চায়, তাকেও কিছু এখানে দেই; তবে পরকালে তার জন্য কোন হিস্যাই নেই’। (৪২:২০)
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।