ভূঁইয়া নজরুল »
আবারো আলোচনায় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নির্মাণাধীন বহদ্দারহাট (এম এ মানান্ন) ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসে ১৫ জনের প্রাণহানি ও অর্ধশত আহত হয়েছিল। একইমাসে গত সোমবার (২৫ নভেম্বর) দিবাগত রাতে আবারো ফ্লাইওভারের চান্দগাঁওমুখী র্যামে ফাটল ও র্যামটি প্রায় চার ইঞ্চি নিচে দেবে যাওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয় যান চলাচল। তবে দিনভর আতঙ্ক শেষে সন্ধ্যায় র্যাম্প অংশের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স থেকে জানানো হয় র্যাম্পে কোনো ফাটল নেই। নির্মাণ শেষেও এই পিলার এমন ছিল এবং এখনো একই।
২০১৩ সালে উদ্বোধন হওয়া বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে চান্দগাঁওমুখী র্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছিল ২০১৭ সালে। ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষের চারবছর পর র্যাম্পটি নির্মাণ করতে গিয়ে ডিজাইনগত ত্রুটির কথা স্বীকার করেন তা নির্মাণের সাথে জড়িত প্রকৌশলীগণ। আর এজন্যই এই র্যাম্প গিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। মূল পরিকল্পনার বাইরে যেয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এই র্যাম্পটি করেন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই র্যাম্প তিনি নিজেই উদ্বোধন করেন। ২০১৯ সালে ফ্লাইওভারটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তরের পর প্রথম দিকে ভারী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ রাখা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেই নিয়ন্ত্রণ আর মানা হয়নি। এমনকি ভারী যানবহন আটকে দেওয়ার যে ব্যারিয়ার (লোহার বার) ছিল তাও খুলে ফেলা হয়, এতে ভারী যানবহন সহজেই এই র্যাম্প দিয়ে উঠানামা করেছে। আর এতেই র্যাম্পটি দেবে গেছে বলে প্রকৌশলীদের ধারণা।
গতকাল দুপুরে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চান্দগাঁও থেকে উঠে আসা র্যাম্পটি বহদ্দারহাট মোড়ের কাছে আসার পর দুই ভাগে ভাগ হয়ে মূল ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত হয়েছে। চান্দগাঁও প্রান্ত থেকে আসা গাড়িগুলো বাম দিকে বেঁকে ফ্লাইওভারে যুক্ত হয়েছে এবং মুরাদপুর প্রান্ত থেকে আসা চান্দগাঁওমুখী গাড়িগুলো ডান দিকের প্রান্ত দিয়ে নেমে যায়। দুই প্রান্তের র্যাম্পের দুটি পিলারে ফাটল দেখা যাচ্ছে। আর এজন্য গতকাল সোমবার রাত ৯টা থেকে র্যাম্পে ( চান্দগাঁওমুখী) যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
কেন এই ফাটল?
প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চান্দগাঁও প্রান্ত থেকে আসা যে র্যাম্পটি বাম দিকে বেঁকে মূল ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত হয়েছে সেটার নিচে কোনো পিলার নেই। ফ্লাইওভার থেকে র্যাম্পের পিলারের দূরত্ব প্রায় ১৮ মিটার (৫৪ ফুট)। এতে পিলার থেকে ১৮ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত ভারী যানবাহন যখন চলাচল করে নিচে ভর নেওয়ার কোনো পিলার নেই। আর তা না থাকার কারণে ধীরে ধীরে র্যামটি নিচের দিকে দেবে গেছে। গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, ফ্লাইওভার থেকে র্যাম্পের কার্পেটিং চার ইঞ্চি নিচে নেমে গেছে। এবিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পুরকৌশল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমি নিজে ফাটলটি দেখেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে ফ্লাইওভার ও র্যাম্পের মাঝখানে পিলারের গ্যাপ বেশি হয়ে গেছে। এখানে আরেকটি পিলার বসানো দরকার ছিল। তবে এটাও ঠিক, নিচে রাস্তা থাকায় সেই পিলার বসানোর জায়গা ছিল না। ফলে ডিজাইনগত ত্রুটি প্রথম থেকেই ছিল একথা বলা যায়।’
তিনি আরো বলেন, ষোলশহর দুই নম্বর গেটের র্যাম্পের মতো এটাও ঘুরিয়ে মূল ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। তাহলে হয়তো এই ঝুঁকিতে পড়তে হতো না। আবার এটাও ঠিক চান্দগাঁওমুখী র্যাম্পটি প্রথম ডিজাইনে থাকলেও তা বাতিল করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আবারো তা নির্মাণ করতে গিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
এদিকে র্যাম্প নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মনির হোসেন বলেন, এটা সঠিক যে ফ্লাইওভার ও র্যাম্পের সংযোগস্থলে একটি পিলারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মূল ফ্লাইওভারটি আগে নির্মাণ হয়ে যাওয়ায় তৎকালীন চেয়ারম্যান মহোদয়ের চাপে আমাদেরকে এভাবে নির্মাণ করতে হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল শুধু ছোটো গাড়ি চলাচলের জন্য এই র্যাম্পটি ব্যবহার হবে। কিন্তু প্রথমদিকে তা মেনে চলা হলেও পরবর্তীতে তা না মানার কারণে দেবে গেছে।
কিন্তু ফাটলের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন,‘যে দুটি পিলারের ফাটল দেখা যাচ্ছে এগুলো ফাটল নয়। পিলার নির্মাণের সময় যে সাটারিং দেয়া হয়েছিল তখন এখানে ফোম ছিল। সাটারিং খোলার পরও এই পিলারটি দেখতে এমন ছিল এবং এখনো একই আছে। এটি ফাটল নয়। সাটারিংয়ের ডিসপ্লেসমেন্ট। ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের একটি টিম হাইলিফট (উপরে উঠার উপকরণ) দিয়ে পিলারের ওই স্থানটি চেক করে দেখেছে। তারা ওখানে কোনো ফাটল পায়নি।’
আসছে বিশেষজ্ঞ টিম
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ইতিমধ্যে ঠিকাদারি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের টিম নিশ্চিত করেছে এটি ফাটল নয়। তবে তারপরও যেহেতু র্যাম্পের টপ লেবেল নিচে নেমে গেছে সেজন্য আজ বুধবার একটি বিশেষজ্ঞ টিম আসবে। তাদের দেয়া দিক নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করবো।
এদিকে এর আগে গতকাল মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় তিনি উপস্থিত মিডিয়াকর্মীদের বলেন, ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি রয়েছে কিনা তা দেখার জন্য সিডিএকে বলা হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালেও এই ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এবার যাতে জানমালের ক্ষতি নয় সেজন্য যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের নকশায় এই ফ্লাইওভারটি ওয়াই ( ণ ) আকৃতির হওয়ার কথা থাকলেও সেই অনুযায়ী নির্মিত হয়নি। বর্তমানে নির্মিত বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে আসা র্যাম্পটি মূল ফ্লাইওভারে লেভেলে আসার পর দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একটি অংশ পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে মুরাদপুরের দিকের অংশে যুক্ত হয়েছে এবং অপর একটি অংশ রাহাত্তারপুলের দিকের অংশে যুক্ত হয়েছে। ফলে মুরাদপুর দিক থেকে যেসব গাড়ি চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা কিংবা বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের দিকে যাবে সেগুলো বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে উঠে বাম দিকের র্যাম্পে উঠে চান্দগাঁও সাউদার্ন সিএনজি স্টেশনের সামনে গিয়ে নামবে। আর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল কিংবা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে আসা যেসব গাড়ি কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর দিকে যাবে সেগুলো র্যাম্পে উঠে বাম দিকে টার্ন নিয়ে শাহ আমানত সেতুর দিকে চলে যাবে। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে আসা গাড়িগুলো মুরাদপুরের দিকে যেতে হলে বাম দিকের র্যাম্প ধরে ফ্লাইওভারে উঠে এক কিলোমিটার থেকে ডান দিকে টার্ন নিয়ে আবারো ফ্লাইওভারে উঠে মুরাদপুরের দিকে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন ফ্লাইওভারের ডিভাইডার ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং গাড়ি এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সহজে ঢুকে যেতে পারে। এতে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে, ফ্লাইওভারের ওপর যানজটও বেড়েছে। সিডিএ নিজস্ব অর্থায়নে ১৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এম এ মান্নান (বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার) ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছিল। ২০১৭ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল চান্দগাঁওমুখী র্যাম্প।