অরূপ পালিত »
কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে অনেক দিনের চেনা পথ। গ্রামের চারপাশে যেন এক ভৌতিক নিস্তব্ধতা। শহরমুখী প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে গ্রাম প্রায় জনশূন্য। অনেক বছর পর আসাতে চেনা জায়গাটাকেও আজ বড় অচেনা মনে হচ্ছে।
এই পথে পা বাড়াতে মনে পড়ে অনেক স্মৃতি। সন্ধ্যা নামলে সব বন্ধুরা কতো গল্প করতো। দাশপাড়ার ভেতরে নির্জন একটা রাস্তা ছিল। সবুজে সবুজে ভরা ছিল সামনের বিশাল বিল। দূরে দেখা যেত দরবার শরীফের লাল-সবুজ আলো। পুব আকাশের দিকে তাকালে মনে হতো হাতছানি দিয়ে ডাকছে করলডেঙ্গা পাহাড়। এই রাস্তায় বসে কতো আড্ডা। সিগারেটের নেশাটা ছিল এক কী দুজনের মধ্যে। বন্ধুদের মধ্যে রিপনের বাবার ছিল কাঁচাপয়সা। সে মোটামুটি বন্ধুদের জন্য পয়সা খরচ করতো।
রাস্তার পাশে বসে গলা ছেড়ে গান গাওয়াটা প্রতিদিনের রুটিনের মতো। বন্ধুদের মধ্যে সজলের কন্ঠস্বর ছিল দারুণ মিষ্টি। সারাদিন হেমন্ত না হয় মান্নার গান মুখে লেগে থাকতো ওর। ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায় … রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোনা যেতো চৌধুরী বাড়ির সব চাইতে সুন্দরী মেয়ে নিশির মধুর কণ্ঠের গান। সরস্বতী যেন ও কন্ঠে ধারণ করেছে। একটি গান খুব ভালো গাইতো।
দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে
কী জানি কী মহালগনে
চাঁদ উঠেছিল গগনে …
শুভ্র সকালের কুয়াশা ভেজা রাস্তায় একা হেঁটে সজল পাড়ি দিচ্ছেন কোন এক নতুন ঠিকানায়। কাঁধে ঝোলানো সেই ভালোবাসার ব্যাগ। সামনের ব্রিজ পার হতে পারলে বেঁচে যায় সজল। গ্রামের লোকজন আর জিজ্ঞাসা করবে না কখন আসছেন, কোথায় ছিলেন, আমাদের গ্রামের লোকের জন্য কী করবেন। এত সব প্রশ্ন শুনতে এখন আর ভালো লাগে না।
হঠাৎ করে সজলের চোখে পড়ে সামনে একজন মহিলা হাঁটছেন।এখন রোগ থেকে মুক্তি পেতে গ্রামের লোকজনও হাঁটতে শুরু করেছে। সামনের মহিলার হাঁটার ধরনটি খুবই পরিচিত। সজল পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেও নিশির চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। দীর্ঘ বছর পর দেখা হলো নিশির সাথে সজলের। ভারী চেহারার সাখে দুজনের দুচোখে উঠেছে ভারী চশমা। দুজনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন যেন। কে কীভাবে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। সজল শুরু করলো নিরুপায় হয়ে। ওর একটা বদভ্যাস ছিল কথায় কথায় হো হো করে হেসে ওঠা। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তুমি কবে এলে বাপের বাড়ি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশি সজলের দিকে তাকিয়ে বললো, অনেকদিন হলো। একা একা শহরে বোরিং লাগছে। মনে হয় স্থায়ীভাবে এখানে থেকে যেতে হবে। এতো তাড়া কিসের সজল! তুমি কী পালাচ্ছো?
নিশির এমন আক্রমণাত্মক কথা সজলের বুঝতে বাকি নেই। এটা কোন সাধারণ মেঘের গর্জন না।মেঘের আড়ালে আড়ষ্ট হয়ে থাকা এক অভিমানের বৃষ্টি। কোন কারণে বাঁধভাঙা শব্দ পৌঁছাতে পারেনি সজলের হৃদয়ে। সজল কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল।
নিশি বুঝলে, বর্তমান সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাম আর কাজ কোনটায় মিল তেমন একটা পাওয়া যায় না। তোমার কী মনে আছে কানুনগোপাড়া কলেজের কথা। বলেছিলে পরীক্ষার শেষ দিন পালিয়ে যাবে। বন্ধু পবন আমাকে বলেছিল তোমাদের পরিবার থেকে সাবধান। সেইদিন আমি কষ্ট করে বসেছিলাম তোমার পথ চেয়ে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। তুমি সেদিন কেন আসলে না? তোমার কোন সমস্যা হয়েছে কিনা দেখতে তোমার বাড়ি পর্যন্ত যাই। দেখে হতবাক! তুমি বেলকনিতে বসে চায়ের চুমুকে ডুবে গেছ। বুঝতে বাকি নেই তোমার বিবেক আবেগের কাছে হার মেনেছে। শেষবারের মতো বলবে কী সেদিন কেন আসনি?
আমি আসিনি তোমাকে কে বলেছে। তোমার জন্য লাইব্রেরিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। পরিচিত কিছু মানুষ আমার পাশে বসা ছিল। তোমার বাড়ির পাশে একটি মেয়ে আমাকে বললো কারো জন্য অপেক্ষা করছিলাম কি না। তাকে সহজ-সরলভাবে তোমার কথা বলেছি। আমাকে সে যেটুকু শোনালো তা সত্ত্বেও মনকে অনেক বুঝালাম। মন সায় দিল না। তোমার ওপর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রাখতে পারছিলাম না। যে ঘর মিথ্যা দিয়ে শুরু, সে ঘরে কী করে ভালোবাসা জন্ম নেবে, বলো তো?
তোমার কথার মানে কিছুই বুঝলাম না।
তোমার বাবার নাম কী? তোমাদের তো এই জায়গায় বাড়ি না। সজলের হাসিটা যেন আগের মতো। মুখে হাসি নিয়ে, ও তাই বলি! আমি নিশ্চিত তোমাকে কথাগুলো সুমনা বলেছে। শয়তানটা বিয়ে করলো না। আমাকে ভালোবাসে সেটা এখনো পর্যন্ত বলতে পারেনি। একদিন ছলছল চোখে বলল। আমি তোমার স্বজাতি না। সে জন্য কী আমার অপরাধ। সেদিন ওর কথার উত্তর আমার জানা ছিল না। ওর ভাই ইউসুফ আমাকে সরাসরি বলেছে, মাস্টার তুই চাইলে ওকে নিয়ে পালাতে পারিস। সব ব্যবস্থা আমি করে দেব।
জানো একটা কথা আমি বুঝি না। তোমরা দুজনে আমাকে ঠকালে, না! নিজেরাও হেরে গেলে। তুমি আমাকে দলদাস বলে একসেপ্ট করনি। আর সুমনা, আমি হিন্দু বলে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারেনি।
আজকে তা হলে বলি। আমার আসল বাড়ি শহরের ফ্রি পোর্টের পাশে, জেলে পাড়ায়। আমার মা ফ্রি পোর্টে চাকরি করতেন। সেখানে একটি স্কুলে মাস্টারি করতেন আমার বাবাও। যাওয়া-আসা বা দেখাদেখি থেকে দুজনের দুজনকে ভালো লাগাতে বিয়ে হয় মা-বাবার। আমার মা কোন সময় আমার বাবার বাড়িতে যেতে চাইতো না। বাবার সাথে বাড়ি যাওয়া নিয়ে প্রায় সময় ঝগড়া লেগে থাকতো।
কারণ আমাদের বাড়ি জেলে পাড়াতে হওয়াতে মা ঘৃণা করতো। আমার বয়স তখন চার । আমাকে স্কুলে ভর্তির জন্য একটা সার্টিফিকেট দরকার হয়। তখন বাবা বলেছেন, আমার পদবি ’জলদাস’ রাখবে না। মা বাদ সাধেন। শুধু দাস রাখতে বললেন ।
বাবার ইগোতে লাগে। এক পর্যায়ে বাবা উত্তেজিত হলে তর্কতাকরিতে স্ট্রোক করেন। মেডিকেল পর্যন্ত নেওয়া যায়নি। এরপর মা আমাকে মামার বাড়িতে নিয়ে আসে। মাকে মামারা কোন সময় মেনে নিতে পারেনি। মামারা আমাকে পছন্দ ও ভালোবাসতেন। কোন সময়ই বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। আমার পদবি দাসের আগে জল আর স দুটোই বাদ দিয়ে মামাদের পদবি দাশ-এ চলে আসি। কী সুন্দর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রথা।
এখানে থাকতে থাকতে কখন যে তোমাদের পাড়ার ছেলে হয়ে উঠেছিলাম বুঝতে পারেনি। তোমার কী তাহলে আমার পদবি নিয়ে এই সমস্যা ছিল।
আমি একটুও কষ্ট পাইনি। বরঞ্চ কষ্ট পেয়েছি তোমার জন্য তোমার মা-বাবা জাত খুঁজতে খুঁজতে তোমাকে বিয়ে দিয়েছে চল্লিশ বছরের বুড়োকে। তোমার কাকাতো বোন দুটিকে তো বিয়ে দিতে পারেনি। তোমাকে অল্প বয়সে স্বামীর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হতে হলো। ছেলেটি পাইনি বাপের আদর।
সজল তুমি আমার ওপরে রাগ ঝাড়তেছ মনে হয়।
তোমার ওপর রাগ করি কীভাবে নিশি?
নিশি নামে আর ডেকো না। নামের সাথে সে ব্যক্তি অনেক আগেই মরে গেছে।
তুমি ঠিক বলেছ। নিজেকে দেখ না, তোমার নামের অর্থের সাথে তোমার কর্মকাণ্ডের ভূমিকা। তোমাকেই বা একা কীভাবে অভিযোগ করি। অন্ধকারে লাইটপোস্টের নিচে, হলুদরঙের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে পেছনের দিকে খেয়াল রাখতে ভুলে যাই।
এখনো চারদিক ফাঁকা সুসানন নীরবতা। দেখ সামনের দিকে। কুয়াশা নিয়ে উষ্ণতার অনুভবে জড়িয়ে আছে শীতের থেকে মুক্তি পেতে লজ্জাবতী লতা। তুমি মানো বা নাই মানো ’জান’ ভালোবাসার উপহার এমনি হয়। বিশেষ করে এ রকম অনুভূতিকে অন্ধকারে মিশিয়ে নিতে ভয় পেতে তুমি। ঠিক বলিনি!
হুঁ বুঝতে পারলাম, বুড়ো বয়সে তোমার ভিমরতি হয়েছে। আগের মতো রয়ে গেলে। এখনও খেয়ালি স্বভাব যায়নি তোমার।
আমি যদি তোমার শব্দজালে জড়িয়ে তোমার কথাগুলো বলি। বইয়ের শেষের পাতায় শুধু একটা অক্ষর লিপিবদ্ধ থাকেÑ সমাপ্তি। পাঠকের কাছে বইটি সেখানেই শেষ। পেছনের পৃষ্ঠায় লেখকের কিছু কথা থাকে। সেখান থেকে নির্দেশনা শেষের কিনারে এসে দাঁড়িয়ে যদি বলো নামের সাথে কাজের মিল খুঁজছি। এটি নির্বোধের পরিচয় ছাড়া আর কিছু কী?
হুঁ সেটাও ঠিক। তোমার নামটা তো অবশ্য আমার দেওয়া। শুনেছি ছেলেটা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা চলে গেছে।
শিক্ষিত ছেলে। এই দেশে রেখে লাভ কী। এই দেশে তো যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মস্থানের অভাব। সাথে ছেলের বউকে সঙ্গে করে পাঠিয়ে দিয়েছি।
নিশি আমি সবকিছু জানি, বড্ডো আফসোস হয় তোমার ওয়ার্ল্ড ক্লাস ছেলের জন্য। যখন শুনেছিলাম বিদেশে যাবার সময় তোমার বাসা থেকে না গিয়ে ঢাকায় গিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিমান ধরেছে। ইচ্ছে করছিল গিয়ে তোমার ছেলেকে একটা খসে থাপ্পড় মারি।
ছাড়ো তো এসব বলে নিজের ভেতর আর কষ্ট বাড়াতে চাই না। নিশি চোখ মুছে বললো, ছেলের সুখে তো আমি সুখী।
জানো যেদিন পত্রিকায় তোমার সাথে ছেলের ছবি দেখেছিলাম, আমার গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল। যখন শুনেছি আইটিতে ওয়ার্ল্ডে এক নাম্বার হয়েছে আমাদের এক বাঙালি ছেলে। আর সেই ছেলেটি ছিল তোমার। তোমাকে ধন্যবাদ। অনেক কষ্টে বাবা মরা ছেলে মানুষ করেছ।
প্রসঙ্গটা বাদ দাও না। তুমি কেমন আছো বললে না তো?
ছলছল চোখে সজলের মুখে একটা মলিন হাসি। নিশির অনেক অভিযোগ সজলের বিপরীতে।
নিশি এবার মুখ খুললেন, তোমার মতো ছন্নছাড়া, ভিতু, কাপুরুষ লোকের পথে পথে ঘুরে কাটানোর দরকার। আমাকে এতোই ভালোবাসলে সেদিন ঘর থেকে তুলে নিলে না কেন?
ছোটজাতের কাছে ভালোবাসা খুঁজে লাভ কী বলো? সজলের উত্তরে এমন মলিনতা ছিল, নিশির হৃদয়ে কোথায় যেন লেগেছে। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে আসছে ভুলে ভরা কষ্টগুলো।
নিশি কাঁপা গলায় বলল, আমার এমন অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করি বলো তো। তুমি তো সমাজের উচ্চশ্রেণির সম্মানিত ব্যক্তি। তোমার তো কোনো অভাব ছিল না। বিয়েটা করলে না কেন?
ভালোবাসি বলে। নিচুজাতের ছেলে বলে তোমার জায়গায় কাউকে বসাতে পারি নাই। আবার হেসে বললো, এখনো তো ভালবাসি।
বয়স তো হলো। শুনেছি তোমার শরীরের অবস্থাও ভালো না। এবার না হয় একটু থেমে যাও।
বয়সের ভারে ভালোবাসা আদৌও কি মরে! আমার তো জানা নেই। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা কোনো না কোনো সময় সামান্য আঘাতে নাড়া দেয়। আহত হৃদয়ের ক্ষতস্থান আবার জ্বলে। মনের অজান্তে চোখের কোণ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঝরবে অবিরাম। এর চেয়ে ভালোবাসার কোনো ধরন বা বর্ণনা কিন্তু আমার কাছে নেই। তোমার ছুটে চলা বদ্ধ কর। তোমাকে দেখে ছেলেমেয়েরা অনুপ্রাণিত হয়। আজকে দেখ তোমার কাছে প্রাণ নেই।
এই মুহূর্তে রাস্তায় আমাকে হাঁটতে দেখে তোমার মনে হতে পারে ওইখান থেকে আমার পথচলা ছিল। সেটা হয়তো তোমার দৃষ্টিতে দেখা। যদি আমার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখ, তাহলে ভুল। আমি যেখান থেকে চলা শুরু করেছিলাম, সেখানে রাস্তার অনেক শাখা-প্রশাখা ছিল। কোথা থেকে আসল এতো শাখা প্রশাখা, একে-অপরের সাথে কখন কীভাবে মিলিত হয়েছে বিধাতা ছাড়া কেউ জানে না। হুঁ এক সময় থেমে যেতে হবে শেষের পথে। ওপরের হুকুমের ভালোবাসা দাঁড়িয়ে যাবে গাড়ি জংশনের কাছে। সিগনালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে শেষের স্টেশনে পৌঁছাতে।
আজকে তো আমি তোমার কোনো শ্রোতা নই। আমাকে দার্শনিকের মতো কথাগুলো বলছো। তোমার কথাগুলো ইউটিউবে আমার ছেলে বেশ শুনতো। তোমাকে সে পরিচয় করিয়ে দিত। তুমি ওর মামার বাড়ির লোক। সে গর্ববোধ করতো। তোমাকে একবার বুয়েটে পা ছুঁয়েছে। তোমার মনে আছে কিনা জানি না। তুমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলে। তোমাকে নিয়ে গর্ব করার মতো সৎসাহস আমার নেই। আমার ছেলেটা করে। ওকে অন্তত তোমার মনের মধ্যে জায়গা দিও।
তোমার ছেলের জন্য আমার দোয়া ছিল, থাকবে। আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিনা জানি না। সামনের সপ্তাহে চেন্নাই যাচ্ছি। ক্যানসার কোন সময় কী ভালো হয়?
অপারেশনে আপত্তি ছিল। তবু সবার অনুরোধে অপারেশন করালেন। দুমাসের মাথায় সজল চেন্নাই থেকে ফিরে আসেন হিমশীতল গাড়িতে চড়ে। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ কাজটি হবে। গ্রামে প্রিয় মানুষটিকে একনজর দেখার জন্য লোকে লোকারণ্য। আজকাল তো জাতধর্মের বালাই নেই। সকল শ্রেণির লোক এই গুণিজনকে শ্রদ্ধা ও এবং ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। এমন দৃশ্য শুধু সিনেমায় দেখতে পাওয়া যায়। ঢাকা থেকে আসা লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যান স্বেচ্ছাসেবকেরা হালকা করে খুলে দিলেন। একজন সুন্দর নারী সাদা চাদরে মোড়ানো মাথা, মুখে কালো মাস্ক পরে শবদেহের পাশের চেয়ারে বসলেন। কান্নার দমকে শরীর কাঁপছে। গাড়িতে পায়ের কাছে সযত্নে রাখা একটি লাল গোলাপ। একটি সাদা পৃষ্ঠায় স্কচটেপ দিয়ে গাড়িতে লাগানোÑ ভালোবাসার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
কিন্তু নিজের লোকের ভালোবাসা কী পেয়েছে? দুজন নারী সাংবাদিক কাঁদতে কাঁদতে বললেন, স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন।
নিশির মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে। চোখের জলে অস্পষ্ট দেখছে সামনের পথ। মানুষের ভিড়ে চিরচেনা হাসি মুখটা আর দেখতে পারছে না। নিজের বলতে কিছু নেই আর। পুলিশের অনুরোধ, সরে দাঁড়ান সবাই। ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লাশ। সমস্ত শরীর দান করে গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
নিশি ফুলের ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। আজকে সব ফুলের পাপড়ি যেন মলিন হয়ে গেছে। শেষযাত্রায় কফিনের ওপর ছিটিয়ে দিল সেই পাপড়িগুলো। আস্তে আস্তে শীতল গাড়িটি লাল সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলে গেল।