প্রয়োজন ছাড়াই উচ্চমাত্রার অক্সিজেন নেয়া হলে স্বাস্থঝুঁকি রয়েছে : ডা. আবদুর রব
সালাহ উদ্দিন সায়েম :
চট্টগ্রামে মেডিক্যাল অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার ধুম পড়ে গেছে। শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবস্থা জটিল হলে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয়। ফলে যারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের অনেকেই ছুটছেন অক্সিজেনের দোকানে। অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সিলিন্ডার মজুদ করছেন বাড়িতে।
খুচরা পর্যায়ে মেডিক্যাল অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা একেকটি সিলিন্ডার বিক্রি করছেন বাজার মূল্যের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি দামে। প্রচুর চাহিদার কারণে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকটও দেখা দিয়েছে। এই সংকটকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করছে অক্সিজেন সিলিন্ডার।
করোনা আক্রান্তদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হওয়াটা অন্যতম সমস্যা। কারণ, এই ভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ফুসফুস। শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে ধীরে ধীরে সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে রোগীর শারীরিক অবস্থা।
পালস অক্সিমিটারে (রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্র) ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন মাত্রাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। ৯৫ শতাংশের কম হলে চিকিৎসা ভাষায় হাইপোক্সিয়া বলা হয়। শরীরে তখন অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন শ্বাস নিতে প্রচ- কষ্ট হয়। সঙ্গে মাথাব্যথা, বুকব্যথা, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
পরীক্ষার মাধ্যমে কারো রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম শনাক্ত হলে, তখন চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধের মতোই অক্সিজেন ব্যবহার করতে হয়। নাকে নল দিয়ে সাধারণত এ অক্সিজেন দেওয়া হয়ে থাকে।
চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতাল, খুলশী হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল ও সীতাকু- ফিল্ড হাসপাতালে রোগীদের হাইফ্লো অক্সিজেন দরকার হলেও বেশিরভাগ সময় এসব হাসপাতালে তা মিলছে না। একসঙ্গে একাধিক রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন হলে কোভিড হাসপাতালগুলোতে রীতিমতো ‘কাড়াকাড়ি ’ করে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হচ্ছে রোগীদের। সিলিন্ডার ফুরিয়ে গেলে নতুন সিলিন্ডার আসতেও দেরি হয় অনেক। এমন করুণ অভিজ্ঞতার কারণে করোনা আক্রান্ত অনেকেই বাড়িতেই চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাদের কেউ কেউ আগেই অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রাখছেন বাসায়। কারণ সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে গিয়েও লাভ হচ্ছে না।
এছাড়া নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নন-কোভিড রোগীরা চিকিৎসা না পাওয়ায় এখন ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে ব্যবহার করছেন। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব সুপ্রভাতকে বলেন, দেহে কতটুকু অক্সিজেন দরকার হবে তার জন্য রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। শরীরের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের পরই প্রতি মিনিটে কতটুকু অক্সিজেন প্রবাহ প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা হয়। প্রয়োজন ছাড়াই উচ্চমাত্রার অক্সিজেন নেয়া হলে স্বাস্থঝুঁকি রয়েছে। উচ্চমাত্রার অক্সিজেনের কারণে রোগীর শরীরের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, একটি মাঝারি ধরনের সিলিন্ডারে মিনিটে এক লিটার অক্সিজেন দিলে রোগী আনুমানিক ২২ ঘণ্টা অক্সিজেন পায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১.৩৬ কিউবিক মিটারের অক্সিজেন সিলিন্ডার এখন বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার টাকা। অথচ করোনা পরিস্থিতির দুই মাস আগে এই সিলিন্ডারের বাজার মূল্য ছিল ৩ হাজার টাকা। বড় সাইজের ৬.৮ কিউবিক মিটারের সিলিন্ডারের বর্তমান দাম ২০ হাজার টাকা। অথচ দুই মাস আগে এই সিলিন্ডারের দাম ছিল ১০ হাজার টাকা।
নগরীর ঈদগাহ এলাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করে মা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা গেছে, একজন লোক অক্সিজেন সিলিন্ডারের দর কষাকষি করছেন। শেষ পর্যন্ত বাড়তি দাম দিয়েই তাকে সিলিন্ডার কিনে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
নগরীর হালিশহর বসুন্ধরা এলাকা থেকে সিলিন্ডার কিনতে আসা আবুল হাসান সুপ্রভাতকে বলেন, আমার বাবা কয়েকদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। গতকাল আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু করোনা সন্দেহে ভর্তি নেয়নি। করোনা পরীক্ষা করিয়েছি, এখনো রেজাল্ট পাইনি। রেজাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে।
বাড়তি দামে সিলিন্ডার কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দাম বেশি নিলেও এখন তো করার কিছু নেই। হাসপাতালে যেহেতু শ্বাসকষ্টের রোগী ভর্তি নিচ্ছে না, তাই বাড়তি দাম দিয়ে হলেও সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে। বিকল্প তো কোনো উপায় নেই।
জানতে চাইলে মা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মো. রুবেল সুপ্রভাতকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির আগে মাসে ২-৩ টা সিলিন্ডার বিক্রি হতো। গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন অন্তত ২-৩ টা সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে।
বাড়তি দামে বিক্রি করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে অক্সিজেন সিলিন্ডারের এখন সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক দোকানে সিলিন্ডার শেষ হয়ে গেছে। যাদের কাছে আছে তারা তিন-চার গুন বেশি দামে বিক্রি করছে।
চট্টগ্রামে অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম ডেলিভারি দেওয়া আরো ৬টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুপ্রভাতের কথা হয়। তারা বলেছেন, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, সিলিন্ডার আমদানি করতে না পারা এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি-সব মিলিয়েই দাম বেড়েছে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকে ফারহানা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী খালেদ তারেক সুপ্রভাতকে বলেন, অনেক মানুষ আতঙ্কিত হয়ে অপ্রয়োজনে সিলিন্ডার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা বাসা-বাড়িতে যদি সিলিন্ডার কিনে নিয়ে যাওয়া হয় সংকট তো হবেই। আমরা গত এক মাস ধরে সিলিন্ডার সরবরাহ দিতে পারছি না। কারণ সিলিন্ডারের আমদানি হচ্ছে না।
এ মুহূর্তের সংবাদ