শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ের পতেঙ্গা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ পাশের অবস্থান। এর ঠিক মাঝেই রয়েছে দেশের বৃহত্তম আড়ত চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। যার মধ্যে কালুরঘাট থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকায় আসা মানুষের সংখ্যা বেশি। এ বিবেচনায় কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে ২০১৭ সালে নেওয়া হয়েছে চাক্তাই থেকে কালুরঘাট রিং রোড কাম উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্প। এ প্রকল্পটি প্রথমে দুই বছর মেয়াদে অনুমোদিত হলেও চলমান পাঁচ বছরে প্রকল্প এগিয়েছে ৬২ শতাংশে। এরমধ্যে দুই দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৪৭০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা আগামীতে আরও বাড়তে পারে বলে জানা যায়।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের কালুরঘাট সেতু থেকে। আর শেষ হয়েছে ৪১ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ পতেঙ্গায়। এর মধ্যে পূর্ব থেকে পশ্চিমাংশের ৪ নম্বর চান্দগাঁও, ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর, ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ও ৩৫ নম্বর বকসিরহাট ওয়ার্ডের যোগাযোগকে সহজ করবে সাড়ে আট কিলোমিটারের এই সড়ক প্রকল্প। এ প্রকল্পে কাজ হচ্ছে তিন ধরনের। এরমধ্যে অন্যতম হলো সড়ক। পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জলাবদ্ধতা নিরসন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ। অর্থাৎ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ কর্ণফুলী নদী রক্ষা ও পর্যটনে অবদান রাখবে।
কল্পলোক আবাসিক এলাকার পাশে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ে চলছে এ প্রকল্পের মূল কর্মযজ্ঞ। পুরো প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নকশা অনুযায়ী সাড়ে আট কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ চলছে। অধিগ্রহণ জটিলতায় বাকি অংশে কোনো কাজ চলছে না। এর পাশাপাশি চলছে স্লুইস গেট নির্মাণের কাজও। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ১০টি স্লুইস গেটের কাজ।
নদীর পাড়ে বাঁধ নির্মাণের জন্য মাটি বসানোর কাজ চলছে। মাটি বসানোর পর বাঁধে পাকা ঢালাই দেওয়া শেষে বসানো হবে কয়েক লাখ ব্লক। ব্লক নির্মাণের কাজে নিয়োজিত শরীফুল নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘আমরা দুই ফুটের স্কয়ার সাইজের অনেকগুলো ব্লক বানিয়েছি। ব্লকগুলো বাঁধের ওপরে বসানো হবে। এগুলো আপাতত খোলা জায়গায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কাজ শেষ হলে কয়েকদিনের মধ্যে ব্লকগুলো বসানো হবে।’
সিডিএর এ প্রকল্পের কাজ করছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প উপব্যবস্থাপক নাছির উদ্দীন দিদার বলেন, ‘এ প্রকল্পে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ের কালুরঘাট সেতু এলাকা থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত নদীর বাঁধ। বাঁধে রাস্তা ও খালের মুখে বসানো হবে রেগুলেটর। এখানে মোট ১১টি রেগুলেটর বসানো হবে। আমরা প্রকল্প এলাকার সাড়ে আট কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটারের কাজ করছি এখন। বাকি অংশে ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা আছে। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের পর্যাপ্ত টাকা না পাওয়ায় সেই কাজ আটকে আছে মূলত। অধিগ্রহণের পর তারা বাকি অংশের জায়গা বুঝিয়ে দিলে, আমরা সে কাজটিও শুরু করবো।’
জানা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পে খরচ হয়েছে ১ হাজার ১৫৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা (৫০ শতাংশ) এবং বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশ। এখন দ্বিতীয় সংশোধনিতে মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। মাঝে দু’দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
এদিকে প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২ হাজার ২৭৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনিতে কিছুটা বাড়িয়ে করা হয় ২ হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এখন ৪৩৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ২ হাজার ৭৪৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটির শেষ সময়ে যেসব নতুন কার্যক্রম যুক্ত করা হবে সেগুলো হলো- রাস্তার দৈর্ঘ্য ৪৮৪ মিটার বৃদ্ধি, আরসিসি কিলোমিটার পোস্ট, বাস-বে (বাস চলাচলে পৃথক রোড), ফুট ওভারব্রিজ, যাত্রী ছাউনি এবং রাস্তার পাশের স্থায়িত্ব বাড়াতে রিভিড পেভমেন্ট নির্মাণকাজ যুক্ত করা হবে। এছাড়া সড়কের মাঝখানে নিউ জার্সি ব্যারিয়ার, দুটি সংযোগ সড়ক অন্তর্ভুক্তি, ২৫০ বর্গমিটারের একটি ব্রিজ, রেগুলেটরের সঙ্গে আনুষঙ্গিক কার্যক্রম যোগ করা এবং বিভিন্ন ড্রেন নির্মাণ যুক্ত করা হবে। পাশাপাশি রেগুলেটরের মুখে স্লোপ প্রটেকশনের কাজ, রিটেইনিং ওয়াল, ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ, ১ হাজার ৮৪টি এলইডি সড়ক বাতিসহ অন্যান্য কাজ যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে।
বর্তমান অগ্রগতি সম্পর্কে কথা হয় প্রকল্পটির পরিচালক ও চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের আর্থিক বরাদ্দ ঠিকভাবে না পাওয়ায় কাজের অগ্রগতি খুব ধীর গতিতে হচ্ছিলো। এরপরেও যতটুকু সম্ভব আমরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিচ্ছি। প্রকল্পের বরাদ্দ পেলে তখন ঠিকাদারদের টাকা পরিশোধ করে দেব। এখন পর্যন্ত আমরা ৬২ শতাংশ কাজ শেষ করেছি। ভৌত উন্নয়নকে গতিশীল করতে টাকার কোনো বিকল্প নেই।’
কাজের অগ্রগতিতে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ জটিলতা মোকাবেলা করতে আমাদের অবশ্যই টাকা প্রয়োজন। টাকা না পেলে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ আটকে থাকছে। তবে এ জটিলতাকে বাদ দিয়ে আপাতত যতটুকু সম্ভব, আমরা ততটুকু করার চেষ্টা করছি। তবে প্রকল্পটি আগে একনেকের সি ক্যাটাগরিতে ছিলো। বর্তমানে তা বি ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০টি স্লুইচ গেটের কাজ শেষ, আরেকটি বাকি আছে। এ ১১টি স্লুইচ গেটের কাজ হলে ১২টি খালের পানি এদিকে পাস হবে। এবং জোয়ারের পানি নগরের এ অংশগুলোতে ঢুকতে পারবে না। এছাড়া প্রায় ছয় কিলোমিটার বাঁধ হয়েছে।’
নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফান্ড অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি আছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরেক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। আশা করছি, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা কেটে গেলে কাজ আরও দ্রুততার সঙ্গে আগাবে। যদিও আমরা ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি ধাপে ধাপে করছি। এতে খরচ কিছুটা বাড়তেও পারে।’