তামাক নিয়ন্ত্রণ : আইনের সংশোধন প্রয়োজন

মো. নাছির উদ্দিন অনিক »

বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় দিন দিন বেড়ে চলছে ফসলি জমিতে বিষবৃক্ষ তামাকের আগ্রাসন, তামাক কোম্পানির বিভিন্ন কূটকৌশলের (সিএসআর) কাছে কৃষি বিভাগ ধরাশায়ী। এক্ষেত্রে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন অতীব প্রয়োজন।
বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলা কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলার সবকটিতে এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও রামু উপজেলার তামাকের চাষ অব্যাহত আছে। সরেজমিনে বান্দরবান জেলার লামা এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায় ঘুরে দেখা যায়, এসব অঞ্চলে বোরো মৌসুমের সবুজের ধানক্ষেত উচ্চ ফলনশীল তামাকের দখলে। কৃষি, সংরক্ষিত বনভূমি, খাসজমিতে চলছে উচ্চ ফলনশীল বিষবৃক্ষ তামাক চাষ। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সরকারি খাসজমি, সংরক্ষিত বনভূমি ও নদীর তীরে তামাক চাষ নিষিদ্ধ থাকলেও কাগজে কলমে তা সীমাবদ্ধ। উৎপাদিত তামাক শোধন (প্রক্রিয়াজাত) করতে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে শত শত তান্দুর (চুল্লি), এইসব তান্দুরে জ্বালানি সরবরাহে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বন বিভাগের গাছ, এতে প্রতিনিয়তই বিপর্যয় হচ্ছে পরিবেশের। তামাক চাষে নারী ও শিশুদেরকেও খাটানো হচ্ছে, এতে করে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে তারা আক্রান্ত হচ্ছে।
সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সাল থেকে এসব অঞ্চলে বিষাক্ত তামাক চাষ হয়ে আসছে। বেশ কয়েকটি কোম্পানি দীর্ঘদিন যাবৎ অত্র জনপদে তামাক চাষ বিস্তারে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করছে।
অন্যদিকে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে কৃষি অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার, বীজসহ নানা প্রণোদনাও কাজে আসছে না। তামাক কোম্পানির কূট-কৌশলের কাছে মার খাচ্ছে কৃষি বিভাগের সব প্রণোদনা। তামাক কোম্পানি সমূহ তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে নিবন্ধনকৃত চাষিদের মোট খরচের ২০% হতে ৫০% অগ্রিম দাদন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) নামে বিশুদ্ধ পানি ও সোলার বিদ্যুৎ প্রদান করে আসছে।
সরকারি খাস জমিতে তামাক চাষ বন্ধে প্রশাসনের কোন প্রদক্ষেপ না থাকায় তামাক চাষে যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন চাষী। বান্দরবান কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. এ কে এম নাজমুল হক জানান, আমার এলাকার লামাতে বেশি তামাক চাষ হয়। এখানে ৭৫০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তামাক চাষ না করে ভুট্টা, চিনা বাদাম ও ফল বাগান চাষে উদ্বুদ্ধকরণে আগের চাইতে বেশি সার ও বীজ প্রণোদনা হিসেবে দিচ্ছি। কক্সবাজার জেলার উপ পরিচালক ড. মো. এখলাছ উদ্দিন জানান, আমার এলাকার চকরিয়াতে ৬শ ৫০ হেক্টর ও রামুতে ৩ হেক্টর তামাক চাষ হচ্ছে, তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে আমরা বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করেছি।
সুত্র জানায়, সরকারি হিসেব মতে তামাক চাষের যে পরিমাণ জমির কথা বলা হয়, বে-সরকারি হিসেব মতে এর তিনগুণ বেশি। তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক সুবিধা হাসিলের জন্য কৌশলগত কারণে কখনো তাদের রেজিস্ট্রেশনকৃত তামাক চাষির সংখ্যা ও জমির পরিমাণের প্রকৃত তথ্য দেয় না।
তামাকের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মোট মৃত্যুর ৬৭% হয়ে থাকে অসংক্রামক(হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ডায়বেটিস) রোগের কারণে। এইসব রোগ এবং মৃত্যুর কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তামাক সেবন। বিশ^জুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ছয়টির সাথেই তামাক জড়িত। শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে মৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়সের উপরে প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৫ শতাংশের বেশি লোক তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্য সেবন করে। তামাক ব্যবহারজনিত নানা অসুখে প্রতিবছর ১ লক্ষ ২৫ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্য থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ২৭ হাজার কোটি টাকা। তামাক ব্যবহারজনিত কারণে মৃত্যুÑঅসুস্থতায় বছরে আর্থিক ক্ষতি ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান শত্রু এই তামাক। তামাকের এই সর্বগ্রাসী ক্ষতি প্রতিরোধে ২০০৩ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল(এফসিটিসি)স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার এতে অনুস্বাক্ষর করে। এই এফসিটিসি হল জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি অনন্য দলিল। বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এফসিটিসির আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।
বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি এফসিটিসির সাথে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু কিছু নতুন বিষয় সংযোজন সহ আইনকে সময়োপযোগী করে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৩০-৩১ জানুয়ারীতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া স্পিকার্স সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।
তামাক আইন সংশোধনে যে বিষয়গুলি আমলে নেয়া দরকার তা হলো ক. সরকারি খাস জমি ও সংরক্ষিত বনভূমিতে তামাক চাষ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করতে হবে এবং তামাক শোধনে তান্দুর (চুল্লী) নির্মাণ ও জ্বালানি কাঠ হিসেবে বনের গাছ কাটা পরিবেশ সুরক্ষায় নিষিদ্ধ করতে হবে। তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে তামাক চাষে লাইসেন্স প্রথা প্রচলন ও স্থানীয় প্রশাসন/কৃষি কর্মকর্তার অনুমতি নিতে হবে।
খ. তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০% এর স্থলে ৯০% জায়গা জুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সর্তকবাণী দিতে হবে এবং মোড়কে কিছু বিভ্রান্তিকর শব্দ (স্পেশাল, স্মার্ট, ন্যাশনাল) নিষিদ্ধ করতে হবে।
গ. তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং এর ব্যবস্থা প্রচলন এবং খুচরা সিগারেট বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আনা। বিক্রয়স্থলে সরাসরি তামাকজাত দ্রব্যের কৌটা ও প্যাকেট প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এর ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক পণ্যের দোকান নিষিদ্ধ করা।
ঘ. সংজ্ঞায় বিড়ি-সিগারেট এর পাশাপাশি, ই-সিগারেট যুক্ত করতে হবে। ই-সিগারেট ও তামাক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা। ঙ. পাবলিক প্লেসের পরিধি বৃদ্ধি করে অযান্ত্রিক সকল যানকেও যুক্ত করা, চ. তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি নিষিদ্ধ করা। ছ. তামাক ক্ষেতে ও তামাক/বিড়ি ফ্যাক্টরেিত উৎপাদনে শিশুদের নিয়োজিত করা নিষিদ্ধ এবং এক্ষেত্রে শিশুদের বয়স নির্ধারণ করে দিতে হবে। জ. ধূমপান এলাকা এবং ধূমপানমুক্ত এলাকায় কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাইনবোর্ড স্থাপন না করলে জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রসিকিউশন দেবার ক্ষমতা রাখতে হবে। তামাকের ওপর কর কাঠামো (স্তর) বিন্যাস করা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে আইনটিকে এফসিটিসির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে সংশোধন করা হলে তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে, যা জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাসে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে।

লেখক : সংবাদকর্মী ও প্রবন্ধকার
হধংরৎধহরশ@মসধরষ.পড়স