এম আব্দুল হালীম বাচ্চু »
ডিসেম্বর এলে সবার মনেই আনন্দের ঢেউ ওঠে। লাল-সবুজ পতাকা উড়তে থাকে বাড়ির ছাদে, স্কুলের মাঠে, এমনকি গ্রামের গাছের ডালেতেও। ধূলাউড়ি ও ডেমরা মাঝামাঝি অবস্থিত লক্ষ্মীপুর গ্রামের ছোট্ট ছেলে তরুর জন্যও ডিসেম্বর ছিল বিশেষ এক মাস- বিজয়ের মাস। কারণ এই মাসেই সে সবচেয়ে বেশি গল্প শুনত তার চাচ্চু আব্দুল আউয়ালের কাছে।
এক বিকেলে তরু বই হাতে চাচ্চুর পাশে এসে বসল। চাচ্চু তখন লাল-সবুজের একটা পতাকা নাড়াচাড়া করছিলেন; “চাচ্চু, আজকে কি তুমি ৭১- এর গল্প শোনাবে?”, – তরু জিজ্ঞেস করল। চাচ্চু মৃদু হেসে বললেন, “শোনাব তো, তবে আজকের গল্পটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের এলাকার, আমাদের মানুষের সাহসের গল্প।” তরুর চোখ চকচক করতে লাগল! চাচ্চু আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলেন- “৭১ সালের সেই কঠিন দিনে, ১৪ই মে, পাকিস্তান বাহিনি আমাদের ধূলাউড়ি ইউনিয়নের বাউশগাড়ি গ্রামে আক্রমণ করেছিল। পাশের গ্রাম ডেমরা জয়গোবিন্দপুর, রূপসীতেও আক্রমণ করেছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের লক্ষ্মীপুর আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যায়! তারা চাইত আমরা যেন ভয় পেয়ে যাই, স্বাধীনতার স্বপ্ন ভুলে যাই। কিন্তু জানো তরু আমাদের এলাকার মানুষ কেউ ভয় পায়নি। সবাই মনে সাহস বলেছিল- একদিন আমরা অবশ্যই জিতব।
তরু মন দিয়ে শুনছিল। শুনতে শুনতে প্রশ্ন করল- “কিন্তু চাচ্চু, তখন গ্রামে যাঁরা ছিল, তাঁরা কী করেছিল?” চাচ্চু বললেন,- “গ্রামের মানুষ একে অপরকে সাহায্য করেছিল। কেউ শিশুদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেল, কেউ আহতদের পানি দিলো, কেউ খবর নিয়ে ছুটে গেল দূর গ্রামে। সবাই একসঙ্গে প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন এলাকার মানুষ ডেমরাতে আশ্রয় নিয়েছিল, সবাই ভেবেছিল ডেমরা নিরাপদ গ্রাম। আর এই সুযোগেই কিছু রাজাকারের সহযোগিতায় পাকবাহিনি সারিবদ্ধভাবে প্রায় ছয় থেকে সাতশো নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে! জীবন দিয়ে হলেও শেষপর্যন্ত আমাদের বিজয় এনে দিয়েছিল প্রত্যন্ত এলাকার তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
তরু গর্বে বুক ফুলিয়ে বলল, “আমাদের এলাকার মানুষ তাহলে খুব সাহসী ছিল!” চাচ্চু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, “তা তো অবশ্যই। আর সেই সাহসের ফলেই আজ আমরা স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচি।” “তারপর কী হলো চাচ্চু?”,- তরু জানতে চাইল। চাচ্চু বললেন, “তারপর এলো ডিসেম্বর, বিজয়ের মাস। এলো ১৬ই ডিসেম্বর। সেদিন আকাশে ভারত থেকে উড়ে আসা যুদ্ধ বিমান বাঘাবাড়িতে অবস্থিত পাকবাহিনির ক্যাম্পে বোমা হামলা করেছিল এবং ওদের পরাজিত করেছিল।
সেদিন থেকেই উড়ল লাল-সবুজের পতাকা। সবাই খুশিতে গান গাইল, ‘জয় বাংলা!’ ‘বাংলার জয়।’ কোনো ভয় নেই, কোনো বাঁধা নেই শেষপর্যন্ত আমাদের দেশ আমাদেরই হলো।” নাম হলো, বাংলাদেশ। তরু একটু ভেবে বলল, “চাচ্চু এই মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?” চাচ্চু বললেন, এটা আপামর জনতা সবাই জানে, আমি ভেবেছিলাম তুমিও জানো; তাহলে শোনো তিনি ছিলেন আমাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরও অনেকেই ছিলেন তাঁর সাথে। তাঁদেরও অবদান আছে। তরু বলল, -”আমরা কি সবাইকে মনে রেখেছি?” চাচ্চু তরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “হ্যাঁ বাবা, তাই তো প্রতি ডিসেম্বর আমরা সবাই পতাকা উড়াই। বীর শহিদদের কথা মনে করি। কারণ তাঁরা না থাকলে আমাদের এই স্বাধীনতা, এই স্কুল, এই মাঠ কিছুই থাকত না। আর শোনো তোমাদের মতো শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তোমরাই দেশের জন্য ভালো কাজ করবে, সত্যবাদী হবে, মানুষের উপকার করবে, এটাই তো বিজয়ের আসল মানে!”
তরু বুকভরা গর্ব নিয়ে চাচ্চুকে জড়িয়ে ধরল।
“আমি প্রতিদিন দেশের জন্য ভালো কাজ করব চাচ্চু। আর সবাইকে বলব, ডিসেম্বর শুধু উৎসবের মাস নয়, সাহস আর ভালোবাসার মাস!” চাচ্চু হাসলেন, আর লাল-সবুজের পতাকাটা তরুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এই পতাকাই আমাদের শক্তি। এটাকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে রাখবে, ঠিক তো?” তরু চাচ্চুর মাথা ছুঁয়ে বলল, “হ্যাঁ চাচ্চু, আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করছি!”
আকাশে তখন হালকা সন্ধ্যার আলো। লাল-সবুজ পতাকাটা তরু দু’হাত দিয়ে উঁচু করে ধরতেই হাওয়ায় দুলতে লাগল, একটি স্বাধীন দেশের অমলিন প্রতিক হয়ে। এভাবেই প্রতি ডিসেম্বরেই বিজয়ের গল্পগুলো নতুন করে ঘুরেফিরে আমাদের মাঝে আসে।





















































