রতন কুমার তুরী »
শক্তিশালী গণতন্ত্র যেসকল দেশসমূহে দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । সেই দেশেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টের প্রত্যয়ন ঠেকাতে ট্রাম্পপন্থিরা সরাসরি তাদের সংসদ ভবনে হামলার মাধ্যমে তা-ব চালাবে তা একেবারেই অচিন্ত্যনীয়। প্রকৃতপক্ষে উগ্রজাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই বিভিন্নভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। নির্বাচনের পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের লাগামহীন কথাবার্তা এবং কোনো প্রতিষ্ঠানকে তোয়াক্কা না করার বিষয়টি বারবার মার্কিনীদের ভাবিয়েছে। তাঁর গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমালোচিত হয়েছে। অনেকটা একগুঁয়ে স্বভাবের ট্রাম্প নিজে যাই বুঝেছে, ক্ষমতায় থেকে তাই করার চেষ্টা করেছে
কিন্ত মার্কিনীরা অবশেষে বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কখনই মঙ্গল বয়ে আনবে না, ফলে মার্কিনীরা গতবছরের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটে ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করে জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে কিন্তু ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ আচরণ অনুযায়ী বাইডেনের জয়কে মেনে নিতে পারেনি এবং নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মনগড়া কথা তার টুইটারে পোস্ট করতে থাকেন, এতে করে তাঁর উগ্র সমর্থকরা ক্রমান্বয়ে ক্ষিপ্ত হতে থাকে, অবশেষে তারা জানুয়ারির ৬ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ ভবন কংগ্রেসে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জয় প্রত্যয়নের সময় সরাসরি সংসদ ভবনে ঢুকে হামলা চালিয়ে নজিরবিহীন তা-ব সৃষ্টি করে।
এসব উগ্রপন্থী ট্রাম্প সমর্থকদের তা-বের কারণে কংগ্রেসের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। কংগ্রেসের অধিবেশন চলাকালীন বেশকিছু সমর্থক কংগ্রেসে ঢুকে পড়লে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়, গুলিতে ট্রাম্পের একজন মহিলা সমর্থক মৃত্যুবরণ করে, অন্যদিকে কংগ্রেসের সিনেটররা সেদিন সুড়ঙ্গ পথে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় বিশ্ববাসী নিন্দা জানাতে থাকে। সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মার্কিন কংগ্রেস বিজয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের জয় প্রত্যয়ন করে দেন আর এতে আগামী ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের শপথ নিতে আর কোনো বাধা রইলো না। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির তথ্যানুযায়ী, ১৮১২ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ ভবনে এ ধরনের আগ্রাসী হামলা হলো। ১৮১৪ সালে ওয়াশিংটনে অভিযান চালানের সময় ব্রিটিশ বাহিনী নির্মাণাধীন ক্যাপিটাল ভবনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এর পর ২০২১ সালে ঘটল আবারও এ ধরনের অঘটন। ৬ জানুয়ারি আমেরিকার আইনপ্রণেতারা যখন নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জো বাইডেনের জয় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করার জন্য অধিবেশনে বসেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শত শত সমর্থক তখন আমেরিকার আইনসভা কংগ্রেসের ভবন ক্যাপিটালে ঢুকে পড়ে। দুপুরের পরই রাজধানী শহরে এই নাটকীয় দৃশ্যে দেখা যায়- শত শত বিক্ষোভকারী ভবনটিতে ঢুকে পড়ছে আর পুলিশ কংগ্রেস সদস্যদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছে।
কয়েক ঘণ্টা ভবন কার্যত দখল করে রাখার পর বিক্ষোভকারীরা ধীরে ধীরে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণ ছেড়ে বাইরে চলে যেতে থাকে। আমরা বিভিন্ন চ্যানেলে ট্রাম্পপন্থিদের যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটাল ভবনের দেয়াল দিয়ে উঠতে দেখেছি, তাতে আঁৎকে উঠেছি। এসব সমর্থথরা সত্যই কি মূর্খ ? তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না? যদি তাই না হয় তারা কিভাবে ক্যাপিটাল ভবনের মতো একটা ঐতিহ্যবাহী ভবনে হামলা করলো? অবশ্য কংগ্রেসের ওই অধিবেশনেই বাইডেনের জয় প্রত্যয়ন করা হলেও ট্রাম্পপন্থিদের হামলা এবং পুলিশের গুলিতে একজন নারীসহ চারজন নিহত হয়। এই চার নিরীহ মার্কিনী নিহত হওয়ার পেছনে ট্রাম্পের উসকানিই যে দায়ী তা নিশ্চিত করে বলা যায়। ট্রাম্প বাইডেনের জয় প্রথম থেকেই মেনে নিলে এমন প্রাণহানি ঘটতোনা এবং মার্কিন ইতিহাসে নির্বাচন নিয়ে এমন একটা খারাপ নজির সৃষ্টি হতোনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত গণতান্ত্রিক দেশে প্রেসিডেন্টের মত একটি ক্ষমতাশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ পদে থেকে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে মেনে না নিয়ে বিভিন্ন টালবাহানা করে শেষ পর্যন্ত দাঙ্গা বাধিয়ে প্রাণহানি ঘটানো সত্যিই দুঃখজনক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক ঘটনা। এতোকিছুর পর ট্রাম্প অবশেষে আগামী ২০ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়েছেন এবং তিনি তাঁর সমর্থকদের শান্ত থাকার আহবান জানিয়েছেন।
সারা পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী সমর্থকরা বেশ উগ্র।
ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরাও এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।এমনকী ট্রাম্পের মতো একজন প্রেসিডেন্ট একই পথে হেঁটেছেন ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস থাকা ভালো তবে, উগ্রজাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হওয়া বিপজ্জনক। এমন বিপজ্জনক খেলায় যেনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর কেউ মেতে উঠতে না পারে সেদিকে মার্কিন জনগণকে লক্ষ রাখতে হবে। আর ক্যাপিটাল ভবনের মতো একটা ভবনে কীভাবে হামলাকারীরা দেয়াল টপকিয়ে ঢুকলো সে প্রশ্ন থেকে যায়। এতে মার্কিন প্রসাশনের নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল কিনা তাও তলিয়ে দেখা দরকার।
ট্রাম্পের এই তা-বলীলায় উসকানি এবং সংঘটিত ঘটনাবলীতে আমেরিকার গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি আমেরিকার চিরাচরিত মানবাধিকার, দল-মত-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি যে নিরপেক্ষ আচরণÑআমেরিকাকে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাও প্রশ্নের মুখে পড়লো। সর্বোপরি ট্রাম্প আমেরিকান সমাজকে বিভক্ত করে দিয়েছেন। বর্ণশ্রেষ্ঠত্ববাদ উসকে দিয়ে সভ্যতাকে কলঙ্কিত করলেন ডোনান্ড ট্রাম্প। ক্যাপিটাল হিলে হামলার পরও তার সুবুদ্ধির উদয় না হওয়ায় বিশ্বের নিরাপত্তাজনিত ও ভারসাম্যমূলক পরিস্থিতি নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাঁকে অভিশংসনের দাবি উঠেছে। এমন কি রিপাবলিকান অনেক জনপ্রতিনিধিও তাঁর এসব উগ্র মতবাদ সমর্থন করছেন না।
আমরা আশা করবো আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, আমেরিকার রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ দেশকে এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। এখন ট্রাম্পের উচিত জো বাইডেনের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে সর্বাত্মক সহায়তা করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর কোনো অশান্তি সৃষ্টি না করে জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেয়া।
আমরা প্রত্যাশা করবো, ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী ২০ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে জো বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তার দুঃখজনক আচরণরের জন্য মার্কিনীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং ভবিষ্যতে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে এক হয়ে মার্কিনীদের জন্য কাজ করবেন।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক