অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ »
মানুষের কল্যাণের জন্যেই সমাজ, রাষ্ট, আইন ও বিচার ব্যবস্থার সৃষ্টি। আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং আইনের শাসনের পূর্বশর্তই হচ্ছে মানবাধিকার বাস্তবায়ন। মানবাধিকার বিশ্বজনীন। মানুষের জন্য স্বীকৃত অধিকার যখন রাষ্ট্র দ্বারা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হয়, তখনই আমরা বলে থাকি মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বরত ব্যক্তি বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ হলো জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং আইন প্রয়োগের যতগুলো পদ্ধতি আছে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা এবং মানবাধিকার লংঘিত হলে বিচার প্রার্থীর বিচার সুনিশ্চিত করা। যে সকল শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয় বিশেষত : যারা পথশিশু, এতিম ও জেলখানায় কয়েদি/হাজতি মায়ের সঙ্গে আছে সে সকল শিশু এবং অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া কিশোর-কিশোরী তাদের মৌলিক ও মানবাধিকার বলে কিছু আছে? দারিদ্রের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত পরিবার। জীবন সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অর্থ উপার্জনের জন্য পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। খোলা আকাশের নিচে গাড়ির ধোঁয়া ও ধুলোবালি উপেক্ষা করে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি খোলাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। কেউবা মাথায় ইট বা ভারি বস্তু নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। কেউ লোহা কাটার কাজে ব্যস্ত।
আমাদের দেশে ভয়াবহ সমস্যা হলো এই শিশুশ্রম। তারা অসহায় ও দুর্বল বিধায় সকল নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করে এবং তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য তারা পান না। এতিম, অসহায়, গৃহহীন, দুঃস্থ, দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় তাদের নিয়োগের অন্যতম কারণ হচ্ছে- তাদের দিনরাত খাটানো যায়। এতে তারা শিক্ষা বঞ্চিত হওয়া ছাড়াও পঙ্গুত্ব বরণসহ অকালে মৃত্যুর মুখেও পতিত হয় অনেকে। আইন থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগ এবং গণসচেতনতার অভাবে শিশুদের এসব কাজে ব্যবহার রোধ করা যাচ্ছে না। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশার মধ্যে রয়েছে- পরিবহন (শ্রমিক টেম্পু, রাইডার, বাস, ট্রাক ইত্যাদিতে), মোটর ওর্য়াকসপ ও গ্রিল ওয়াকসপ, লেইদ মেশিন ইত্যাদিতে, শিপইয়ার্ডে, ইঞ্জিন বোট ও মাছ ধরার ট্রলারে, নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে, কেমিকেল কারখানায়. রাজনৈতিক সহিংসতায় ও কর্মসূচিতে ব্যবহার, ধূমপান ও মাদক ব্যবসায় নিয়োগ, ইট ভাটায় ইত্যাদিতে।
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন-১৯৭৪, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা, জোরজবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে সকল কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে।
আমাদের শ্রম আইনেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী বা কিশোর যারা সপ্তাহে ৪২ ঘন্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। তবে কোন শিশু (চৌদ্দ বছর পূর্ণ হয় নাই এমন কোন ব্যক্তি) যদি কোন ধরণের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘন্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার ঃ ৭বছরের নিচে শিশুর কোন আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে শিশুর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, ১২ বছরের নিচে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। ১৪ বছরের নিচে কারখানায় কাজ নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহন খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নিচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বে-আইনি। শিশুদের প্রতি সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের মতো প্রধান প্রধান যেসব হুমকি আছে সেগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে তাদের কিশোর বয়সেই। এই বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রধানত কিশোরেরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে অথবা শিশুশ্রমিক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব কারণে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা বা দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ কমে যায়। শিশুকাল যদি আনন্দময় না হয়ে ভীতিময় হয়, তাহলে সেই শিশু সারাজীবন হতাশায় ভোগে। শিশুদের প্রথম শিক্ষা শুরু হোক আনন্দ নিয়ে। আর এই আনন্দশিক্ষা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার। প্রয়োজন কোমলমতি শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব সমাজ ব্যবস্থার পাশাপাশি শিশুবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে যদি শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। শিশুরা কখনই নির্যাতনের শিকার হবে না, এজন্য সংশ্লিষ্টদের নজর রাখা দরকার।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য খুবই প্রয়োজন। এখান থেকেই আবেগ, চিন্তা ও ভালো লাগা তৈরি হয়। সৃজনশীলতা বিকাশেও এটি দরকার। অন্যথায় তারা বিপথে যেতে পারে। প্রারম্ভিক শিক্ষায় কাউকে জোর করে আটকে রাখাটা অযৌক্তিক। সব শিক্ষার্থী সব বিষয়ে সমান দক্ষ হতে পারে না। শিশুর চাহিদা, আগ্রহ ও সামর্থের কথা বিবেচনা করে তাদের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষার আয়োজন করা হয়, তাই শিশুবান্ধব শিক্ষা। অভিভাবকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা পরিহার করতে হবে। ভাল ফল করতেই হবে- বাড়িতে অভিভাবকের অন্তহীন প্রত্যাশা, স্কুলেরও আকাক্সক্ষা, সেই স্কুলের নাম ছড়িয়ে পড়বে, এমন চাপে অপরিণত মস্তিষ্ককে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে রেখে দিচ্ছে। মেধার স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে শিশুদের মাঝে অনাকাঙ্খিত পরীক্ষাভীতি তৈরি হচ্ছে। পড়াশোনার চাপের পেছনে অভিভাবকদের একটি বড় ভূমিকা থাকে। তাই তাদের সচেতন হতে হবে এবং কিছু বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উভয় বিকাশকেই বাধাগ্রস্ত করে। তার ওপর যদি বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে খেলার পরিবেশ না থাকে, সর্বদা কড়া শাসন ও চাপ থাকে তাহলে তাদের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। কিন্তু তারা জানে তাদের পড়ালেখা করতে হবে, এটা করতে তারা বাধ্য। শিশুদের কল্যাণের জন্যই শিক্ষা। এর প্রতি শিশুর আগ্রহ থাকাটা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। শিশু প্রতিনিয়ত শেখে। কারণ জীবনধারনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, নিজের চেষ্টায় এবং অন্যের সহযোগিতায় শিশুকে সবকিছু ক্রমে ক্রমে রপ্ত করতে হয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরামর্শকেন্দ্র চালু করা এবং মাঝে মধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা ক্লাশের ব্যবস্থা করা দরকার। বয়স অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সময় তার স্বভাবচরিত্র ও বংশমর্যাদাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। মেধাবী, চরিত্রবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষকদের অবশ্যই শিশুবান্ধব হতে হবে।
শিক্ষকদের শিশুবান্ধব পাঠদানে উপযোগী, আন্তরিক ও দক্ষ শিক্ষক প্রস্তুতের লক্ষ্যে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান আরোও ত্বরান্বিত করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ কোমলমতি শিশুদের প্রতি অধিক যত্মবান হবেন। বাবা-মার কাছ থেকে যা কিছু শিখে তার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করে একজন শিক্ষকের নিকট থেকে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে সকল পেশার মানুষের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে শিক্ষার উন্নয়নে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে কোন ভাবেই পিছিয়ে থাকার কথা নয়। অবশেষে বলবো, শিশুরা হচ্ছে সমাজ নামক বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে সংশ্লিষ্ট সকলের এগিয়ে আসতে হবে। শিশুদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের উচিৎ ভবিষ্যতে তাদের সুনাগরিক হবার জন্য সব প্রকার চেষ্টা অব্যাহত রাখা।
লেখক : প্রাবন্ধিক