ঝরে যাওয়া পাহাড়িফুল

অরূপ পালিত »

দীপু বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছেন কয়েকদিন হলো। আজকাল শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। মনে হয় ওপর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন তিনি। অফিসে প্রচুর ঝামেলা। প্রতিদিন বন্দর হতে পণ্যখালাস দিতে গিয়ে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। সময়ের অভাবে বাসায় ফেরা হয় না প্রতিদিন। পিছুটান নেই বলেই বাসাতে আর ফিরতে মনও চায় না দীপুর।
দীপুর বাসাটি অফিস থেকে অনেক দূরে বহদ্দারহাট এলাকায়। সকালে বাসায় গিয়ে অফিসে আসতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। তনি মনে-মনে চিন্তা করেন ভোরবেলায় বাসায় যাবার সময়ে রাস্তাঘাটে অনেক বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে বাসায় না গিয়ে ফকিরহাটের ওরিয়েন্টাল রেস্টুরন্টে বসে একটি নান-রুটি দিয়ে চা-তে চুবিয়ে-চুবিয়ে খেতে খেতে সকাল হয়ে যাবে। সকাল-সকাল চা দিয়ে নান-রুটিতে চুবিয়ে খাবার মজাটাই আলাদা। চা খেতে-খেতে সিগারেটে সুখটান দিতেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মনে-মনে চিন্তা করন দীপু সকাল-সকাল কেউ আসার আগে অফিসে গিয়ে গোসলটা সেরে একটু বিশ্রাম নিলে শরীরও মন ফ্রেশ হয়ে যাবে।
দীপু এই চাকরিতে আসার আগে গার্মেন্টসের চাকরি করতেন। সারা মাস পরিশ্রম করে মালিক মাস শেষ হলে টাকা দেয় কিস্তি করে। সেই টাকাতে সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায় সবসময়। বাঁচার তাগিদে চাকরিটা ছেড়েই দেন। বন্দরে বন্ধুর সাথে পণ্য খালাসের চাকরি নেন শেষমেশ।
দীপু এখন রাতদিন শুধু কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে ভালবাসেন। এক সময়ের তারুণ্য-উচ্ছল ছেলে দীপু। মনোবল আর ভালোবাসা সব হারিয়ে ফেলেছেন এখন। কয়েক বছর হয়েছে জীবনের সবচাইতে মূল্যবান উপহারটি হারিয়ে ফেলেছেন। ভেঙে গেছে মন। তাই এখন আর কোনো কিছুতে তাড়াহুড়ো নেই।
লেখাপড়া অবস্থায় দীপু সবার আদরের ছিল বলে ঘুম থেকে উঠতে অনেক বেলা হয়ে যেত। মায়ের বকুনি ছিল রোজ, আর বড়ভাইয়ের স্ত্রীর ছিল আদর ও সোহাগ। বড় ভাবির জন্য দীপুকে বাসায় কেউ কিছু বলতে পারতো না। কেউ বকা দিলে ওল্টো ওদের সাথে লেগে যেত। কারণ বড় ভাবির ভাই নেই। ওনারা পাঁচবোন। ওনার ভাই না থাকায় বেশি আদর পেত দীপু। দীপুও ওনাকে সেই সম্মান দিয়ে চলেন। কোনো সময় ভাবিকে ভাবি বলে সম্বোধন করেননি। সব সময় বড়বোন মনে করে দিভাই বলে ডাকতেন। এদের সম্পর্কটি দেখলে আত্মীয়স্বজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত। সবাই মনে করতো এরা মা-ছেলে।
রাঙামাটি তবলছড়ি বাজারে দীপুর বাবার বেশ নামডাক আছে। সেখানে ওর বাবার হোটেল এবং বোর্ডিংয়ের ব্যবসা। আর বড়ভাই সরকারি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা।
দীপুদের বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার ছিলেন শিউলির বাবা কনক চাকমা। কনকবাবুকে বাজারের সবাই শিউলির বাবা বলে সম্বোধন করে। হঠাৎ করে শিউলির বাবা বোর্ডিংয়ে আসা বন্ধ করে দেন। দীপুর বাবা চিন্তায় পড়ে যান। কনকবাবু ছিলেন দীপুদের খুব বিশ^স্ত। অনেক দিন থেকে ওদের ব্যবসা কনকবাবু একাই সামাল দিচ্ছেন। তিন-চার দিন দেখার পর দীপুর বাবা দীপুকে পাঠায় কনকবাবুর খোঁজ খবর নিতে।দুর্গম আঁকাবাঁকা পথে প্রায় দুঘণ্টা হেঁটে পাহাড়ের উঁচুনিচু বেয়ে শিউলিদের বাড়িতে পৌঁছেন দীপু। শিউলির বাবা মাচার ওপরে বসে মুখ কালো করে আকাশের পানে চেয়ে আছেন। ওনাকে দেখে মনে হলো পৃথিবীতে ওনার কেউ নেই। দীপুকে দেখে দৌড়ে নেমে আসেন কনকবাবু, কোথায় বসতে দেবেন ছোটবাবাকে, অস্থির হয়ে ওঠেন কনকবাবু।
ছোটবাবা, আপনি এখানে কি করে আসলেন ?
আঙ্কেল আপনি বোর্ডিংয়ে যাচ্ছেন না কেনো, বাবা আমাকে তাই পাঠালেন আপনাকে নিতে। আপনার কি শরীর খারাপ?
দীপুর কথায় কনকবাবুর দু-চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।
বাবারে শিউলির মা আজ চারদিন হলো মারা গেছে। ঘরে এখন আমার উপযুক্ত মেয়ে। তাকে একা রেখে আমি চাকরি করতে যেতে পারছি না। মনে হয় না ছোটবাবা আর যেতে পারবো। বাবাকে বলো ওনি যেন আমাকে মাপ করে দেন।
কনকবাবুর কথায় দীপুর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কনকবাবু শিউলিকে ডেকে বললেন। মা আমার ছোটবাবা আসছেন, একটু চা-টা দে-রে মা।
শিউলি ভেতর থেকে চা নিয়ে এসে দীপুর সামনে দাঁড়ায়। সাদাসিধে লাবণ্যময় চেহেরা। মায়াবী চোখ যেন দেবী অপ্সরী ইকোকে হার মানায়।
শিউলিকে দেখে দীপুরচোখ আটকে যায়। চোখ ফেরাতে পারে না। অপরূপা বললে ভুল হবে শিউলিকে। পাহাড়ি মেয়ে নাকি বনপরি! মনে হয় সদ্যকলি ফুটে বেরিয়েছে ফুল। যেন কোন রূপকথার রাজকন্যা। দীপু মনে মনে বললে, বিধাতা আমার জন্ম যেন সার্থক হয়ে গেছে এমন পাহাড়ি ফুল দেখে। শিউলিকে দেখার পর চা-টা আর মুখে তুলতে পারছেন না দীপু। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন শিউলির মুখের দিকে। জীবনে কত পাহাড়ি মেয়ে দেখেছেন, এমন সুন্দর মেয়ে তো দেখেননি।


দীপু শিউলির বাবাকে বলেন, আঙ্কেল, আপনি অজপাড়া গ্রামের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে একা কী করে থাকবেন। তার চেয়ে ওকে নিয়ে শহরে চলেন। এখানে থেকে মেয়ের নিরাপত্তা দেবেন কী করে, আপনাকে তো চাকরি করেই খেতে হবে, তাই না।
: ছোটবাবা, আমি একটু চিন্তা করে দেখি। আপনাদের অফিসে আমি যে বেতন পাই, তা দিয়ে শহরে দু’জন মানুষ চলতে পারবো কি না। একটু ভেবে দেখতে হবে।
ঠিক আছে বলে দীপু মাথা নাড়েন। কিন্তু শিউলিকে ফেলে আসতে দীপুর মন কিছুতেই চায় না। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসতে। দীপু যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ শিউলিকে প্রাণভরে দেখেছে। আসার সময় বারবার শিউলির দিকে তাকাচ্ছে। ইচ্ছে করছে শিউলির হাতটি একবার ছুঁয়ে দেখতে, আসলে সে ঠিক দেখছে কি না।
শিউলি গত বছর এইচএসসি পাস করেছে। অসুস্থ হয়ে মা বিছানায় পড়ে যাওয়ায় বিএ ক্লাসে ভর্তি হতে পারেনি। আর এখন প্রতিবেশী ছেলেদের জন্য বাড়িতে একা থাকাটাও খুব রিস্কি হয়ে গেছে মেয়েটার জন্য।
শিউলির বাবার কথাগুলো দীপুর বুকের মধ্যে তিরের মতো বিঁধে গেছে। চলে আসার সময় দীপু শিউলির বাবাকে বলে আসে, যে কয়েকদিন আমার বাবা-মা এখানে আসছেন না, আপনাকে চাকরিতে আপাতত যেতে হবে না, আমি কি করতে পারি আপনাকে এসে জানাবো।
বাসায় এসে দীপু ভাবিকে সব বুঝিয়ে বলেন। বাবার থেকে অনুমতি নিয়ে দীপু দুদিন পর ভাবিসহ উপস্থিত হন শিউলিদের বাড়িতে।
ভাবিও বুঝতে পারলেন, এমন সুন্দরী মেয়ে দেখে দীপুর মনে কি চলছে। দীপুর কথা রাখতে ভাবি নিজ দায়িত্বে তবলছড়ি বাজারে ছোট একটি বাসা ঠিক করে দেন শিউলির বাবাকে। শিউলিদের বাসাটা দীপুর বাসার কাছে হওয়াতে দীপুর জন্য বিষয়টা যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। কয়েকদিন হতে দীপুর ভাবি খেয়াল করলেন দীপুর যেন সবকিছতে পরিবর্তন এসে গেছে। সে এখন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ে। প্রায় সময় কিছু না খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। কলেজ না থাকা অবস্থায়ও দেরি করে বাসায় ফিরছে। ভাবির মনে সন্দেহ জাগে।
দীপুকে রাতের বেলায় ভাবি দিলারা ডেকে বলে,দীপু তুই তো জানিস, তোকে আর তোর ভাতিজাকে আমি কোনো সময় আলাদা করে দেখেনি। তোরা দুজন আমার সন্তান। আমি চাই না আমার সন্তান বিপথে চালিত হোক। ইদানিং তোর চলাফেরা আমার ভালো ঠেকছে না। আমিও একজন মা। আমার চোখ এড়াতে তোর কষ্ট হবে। তোর ভাই যদি তোর এসব জানতে পারে, তাহলে তোকে কিছু বলার আগে আমাকে শেষ করে দেবে।
দেখ শিউলিকে আমি আমার জান-প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবো। তুই মাস্টার্সটা কমপ্লিট করে নে। তুই আমাদের সবার আদরের ছোটভাই। তোর দাদাভাইয়ের স্বপ্ন তোকে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে পাঠাবেন। লেখাপড়া শেষ করে একটা পজিশনে দাঁড়ালে বাবা-মাকে আমি বুঝালে বুঝবেন। তোদের এই বয়সটা ভুল করার বয়স। পা ফেলতে সাবধানে ফেলতে হবে।তোর দাদাভাইয়ের সাথে আমি কথা বলে রাখবো। সে যে ধর্মের হোক না কেন, আমি মেয়েটিকে তোর জন্য নিয়ে আসবো। আর মেয়েটিকে আমাদের ঘরের জন্য উপযুক্ত করে তোলার জন্য যা যা দরকার আমি করবো। তোকে আমি কথা দিলাম। তুই আমাকে কথা দে তুই ওল্টোপাল্টা কিছু কররার চিন্তা করবি না। দীপু শিউলিকে পাবার জন্য অন্ধ। ভাবিকেও বিশ্বাস করাতে পারছে না সে।
দীপু কলেজের নাম করে এখন দিনরাত শিউলিকে নিয়ে ব্যস্ত। বছর যেতে না যেতে দুজন দুজনের জন্য পাগল হয়ে ওঠে, ওরা দুজন সিদ্ধান্ত নেয় পালিয়ে বিয়ে করার। দীপু বাসায় এখন কারো কথা শুনছে না, এসব দেখে দীপুর ভাবিও দীপুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন।
বাবা ও বড়ভাই দীপুকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, মেয়েটিকে যদি তুই বিয়ে করিস তাহলে তোকে ত্যাজ্য সন্তান বলে ঘোষণা করা হবে।
দীপুর বাবা শিউলির বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন মেয়েটিকে যেন তাড়াতাড়ি অন্যদিকে বিয়ে দিয়ে দেন। দীপু ও শিউলি বুঝতে পারে পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া ওদেও জন্য আর কোন পথ নেই। দীপু শিউলিকে নিয়ে পালিয়ে বহদ্দারহাট এলাকায় চলে আসে।
দীপু একটা গার্মেন্টসে চাকরি নেন। প্রতিদিনের মতো সকালে যায় আর রাতে ফিরেন। শিউলিও বাসায় একা থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে ওঠে। শিউলিও ভাবে সে আবার পড়াশোনাা করবে। একমাত্র মেয়ে বলে কথা। শিউলির বাবা মেয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন।
শিউলির বাবা একদিন এসে শিউলিকে বলে গেলেন তোর প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়েছে। জামাইকে বলবি চাকরিটা যেন করতে দেয়। সরকারি চাকরি। রাতে দীপু বাসায় ফিরলে বুঝিয়ে বললো শিউলি। দীপুও রাজি হলো। শিউলির নতুন চাকরি। বেশ কয়েকদিন আনন্দে আর ভয়ে কাটলো।একা মেয়ে মানুষ কেমন করে এতদূর থেকে আসা-যাওয়া করবে। হেডমাস্টার ক্লাসে শিউলিকে পরিচয় করিয়ে দেন। স্কুলে জয় নামে একজন টিচার আছেন, শহর থেকে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করেন। এটা শুনে শিউলির মন একটুভরসা পেলো। মনে মনে ভাবলো, অন্তত একজন যাওয়া-আসার সঙ্গী পাওয়া গেছে।
বেশ কয়েক মাস দুজনের এক সাথে যাওয়া-আসাতে কেটে গেছে। হাসি খুশিতে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলো দুজন। খাবারও এখন ভাগাভাগি করে খায়। আস্তে আস্তে শিউলির স্বভাব-চরিত্র, কথা বলা সবকিছু যেন জয়ের ভালো লাগতে শুরু করে। জয় শিউলির জন্য ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে ওঠে। ইদানিং শিউলির সারা শরীরে অভাবনীয় সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। জয় যখন একসাখে আসার সময় বাসে উঠে বসে, সেই স্পর্শে সারা শরীওে শিহরন খেলে যায়। শিউলিরও মনে তখন কেমন জানি এক অনুভ’তি জাগে। শিউলি নিজেকে প্রশ্ন করে, জয়ের প্রতি কি কোন দুর্বল হয়ে পড়ছি না তো। সেই মুহূর্তে দীপুর মুখটা ভেসে উঠলে শিউলির খুব খারাপ লাগে।
ছয়মাস যেতে দিপু একদিন শিউলিকে বলে তোমার শরীর ভেঙে যাচ্ছে। মনে হয় ইদানিং তুমি কিছু একটা নিয়ে টেনশনে আছ। এই বর্ষার দিনে তোমার একা একা যাওয়া-আসাতে কষ্ট হচ্ছে। চিন্তা হয় রাতে কোন বিপদ না হয়। তুমি কয়েক সপ্তাহ বাপের বাড়িতে থাকো। আমি শুক্রবার হলে গিয়ে নিয়ে আসবো। দীপুর কথাগুলো শিউলির কেমন জানি লাগে।কষ্ট অনুভব হয় বুকের ভেতরে। যে মানুষটা আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না, সে আমাকে বাপের বাড়িতে কেন থাকতে বলছে। আমাকে কি সন্দেহ করছে? জয় ছেলেটা দেখতে-শুনতে খুবই সুন্দর। স্কুলে শিউলির আশেপাশে জয় হাঁটলে টিচারেরা প্রথমে একান-ওকান করে। দীপুর সকালের আচরণ মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে শিউলির। জয় কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, কি হয়েছে তোমার, মুড অফ কেন ?

৩.
স্কুল ছুটি। পাহাড়ের বুকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। জয় আর শিউলি দু’জন এক সিটে বসা। জয় পাশে বসা। কিন্তু শিউলির মনটা পড়ে রয়েছে দীপুর কাছে। মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বজ্রপাত হচ্ছে খুব। বাস কিছুদূর আসার পর শোনা যাচ্ছে সামনে পাহাড় ভেঙে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। বাস আর যাবে না। সামনে হেঁটে গিয়ে টেক্সি নিয়ে যেতে হবে শহরে।
অন্ধকার রাত। ভয়ে খুব শক্ত করে জয়ের হাতটি চেপে ধরছে শিউলি। হঠাৎ করে এমন বজ্রপাত হলো যেন শিউলির মাথার ওপর দিয়ে গেছে। শিউলি ভয়ে জয়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলে। জয়ের জড়িয়ে ধরার উষ্ণতায় শিউলির ঠোঁট দুটো এগিয়ে আসছে। অজানা ভালোলাগার অনুভবে দুজন কখন যে নিজেদের সীমনা পেরিয়ে গেছে, নিজেরাও জানেনা।
শিউলির তৃষ্ণার্ত ঠোট লাল হয়ে গেছে প্রথম চুম্বনে। হাত-পা অবশ। ভালোলাগার নদীতে ডুবে গেছে। মুখে কপাল ছুঁয়ে ঠোটের ওপর সামান্য স্পর্শ দিতে সব নিয়ে গেছে জয়, জয়ের জয় হয়েছে।
কিšুÍ শিউলি এখন এই মুখটা কেমন করে দেখাবে দীপুকে? মরণ ছাড়া তো কোন গতি নেই আর। সামান্য ভুলে সব তছনছ হয়ে গেছে।
ভীষণ লজ্জায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে কাঁদতে থাকে শিউলি, জয়ের কাছে মনে হয়েছে, এই যেন কোন প্রথম ভালো লাগার আবিষ্কার। কেঁদে ফেলে জয়কে জড়িয়ে ধরে শিউলি, কি করেছে তুমি আমার ?
এতো বড় সর্বনাশ তুমি কি করে করতে পারলে, শিউলি গুমরে কেঁদে ওঠে।জয় শিউলিকে বলে তুমি চাইলে আমাকে শাস্তি স্বরূপ এই উঁচু পাহাড় থেকে ফেলে দিতে পারো। কারণ ভুল আমার হয়েছে। আমাকে শুধরানোর সুযোগ দাও। সত্যিই আমি তোমাকে প্রচ- ভালোবাসি, এতোদিন আমার বলার সাহস ছিল না। এ মূহূর্ত থেকে তোমাকে আমি আমার স্ত্রী হিসাবে পেতে চাই। তুমি এই দুটি থেকে একটা প্রস্তাব গ্রহণ করো। না হলে আমি তোমার থেকে অনেক দূুরে চলে যাব। জীবনে আমি আমার মুখ তোমাকে কখনো দেখাবো না।
শিউলি রাতে বাসায় গিয়ে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে, কি করেছে সে। দীপু সারাদিন পরিশ্রম করে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। শিউলির ঘুম আসে না । অপরাধ আর লজ্জায় দীপুর পাশ থেকে ওঠে যায়। দীপুর মুখের দিখে তাকাতে বুক ফেটে কান্না আসে।
রাতে যে মানুষটির গায়ের ওপর হাত না রাখলে শিউলির ঘুম আসে না, আজ সেই সহজ-সরল লোকটিকে ঠকালো কীভাবে সে?। দীপু ঘুমের ঘোরে বেশ কয়েকবার শিউলিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শিউলি বারবার নিজের গায়ের ওপর থেকে দীপুর হাতটি সরায়ে দিচ্ছে। দীপু মনে করেছে বাপের বাড়িতে যেতে বলায় শিউলি রাগ করেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠলে আবার ঠিক হয়ে যাবে।
শিউলি সারারাত ঘুমায়নি। সকালে দীপু ঘুম থেকে ওঠে দেখে একটা চিরকুট :
ও প্রিয় মানুষ আমার,
ভালোলাগা কোন সময় ভালোবাসা হতে পারে না। প্রিয় বলে সম্বোধন করার অধিকারটুকু হারিয়ে গেছে আমার। আমাকে তুমি যে পাহাড়িফুল বলে ডাকতে সে নামটাকে কলঙ্কিত করে ফেলেছি আমি নিজেই। ফুল কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে ঝরে পড়ে। মনে করবে আমি না হয় সে ঝরাফুলটি।