জ্ঞানতাপস ও বুদ্ধিমুক্তির যোদ্ধা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : একজন ছাত্রের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোহীত উল আলম »

স্যার নিজের হাতলওয়ালা চেয়ারটি দেখিয়ে দিয়ে বললেন, বোসো।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যার আবার একই চেয়ারটি দেখিয়ে বললেন, বোসো।
আমি বললাম, স্যার, এটাতো আপনার চেয়ার। আমি বসব কী করে!
স্যার বললেন, অনেকটা স্নেহমিশ্রিত আদেশে। ‘বসো না।’
আমি ভয়াবহ সংকোচ নিয়ে বসলাম। স্যার বসলেন, যে সোফায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থীরা দেখা করেন সেটিতে।
আমি ঢাকায় গেছিলাম স্যারকে আমার ৭ম কাব্যগ্রন্থ পড়ন্ত বেলায় কবিতা শতক বইটি উপহার দিতে। স্যার আগে ধানমন্ডির ১২-এ সড়কে থাকতেন। ডেভালাপাররা বাড়িটা তৈরি করছে, সে জন্য স্যার বত্রিশ নম্বরের কাছাকাছি একটি ভাড়া বাড়িতে ছোট মেয়েকে নিয়ে থাকছেন। আমি আসব জেনে স্যার দরজাতেই অপেক্ষা করছিলেন। যদিও স্যার আমার শিক্ষাগুরু, আমার পিইচডির সুপারভাইজার, এবং আমি শিক্ষাগুরু হিসেবে সারাজীবন তাঁকে দেখি, কিন্তু আমরা যখন দু’জন একান্ত আলাপচারিতায় বসি, বয়সের এবং পাণ্ডিত্যের ব্যবধান সাথে সাথে ঝরে পড়ে। দুজনই একান্ত বন্ধুর মতো দেশের এবং পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলাপে মেতে যাই। ২০২২ সালে তৃতীয় চোখ-ও প্রকাশক আলী প্রয়াস আমার সত্তরতম জন্মবার্র্ষিকীতে নিজেরে করো উন্মোচন শীর্ষক একটি মোটাসোটা সম্মানী গ্রন্থ বের করেন। ১৬৬টি লেখার মধ্যে স্যারের আমার ওপরে লেখাটি ছিল সূচিতে প্রথম, যেখানে স্যার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আমাকে বন্ধুর মতোই দেখেন। আমি ঢাকায় গেলে চেষ্টা করি স্যারের বাসায় একবার যেতে। আমার এত ভালো লাগে স্যারকে।
স্যারের ওপর আমার বহু স্মৃতিকথা ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে এর আগে প্রায় চারটি প্রবন্ধে লিখেছি। ওই লেখাগুলো এখন সাথে নেই, তাই নতুনভাবে স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধা পেশ করছি।
স্যারের জন্ম ২৩ জুন ১৯৩৬। ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অস্তমিত হয়। ফিনিক্স পাখি যেমন ছাই থেকে আবার জন্মগ্রহণ করে, তেমনি কাকতালীয়ভাবে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে স্যারের জন্মদিনের মিল থাকাতে তাঁর মধ্যে যে জেগে ওঠার স্পৃহা হবে না, তা নয়। স্যার শুধু নিজেকে জাগালেন না, সমগ্র জাতিকেও জাগিয়ে রাখলেন। বাংলাদেশের বৃদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বলে যে মেকী সমাজটি সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে একান্ত রাজনৈতিক দলীয় মতাদর্শের নামে নিজেদের আখের গোছানোর তালে মেতে থাকে, স্যার এই নপুংসক দলের মধ্যে হলেন একান্ত ব্যতিক্রম। তাঁর একান্ত ছাত্র প্রয়াত জিয়াউদ্দিন বাবলু স্যারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করানোর ইচ্ছায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু স্যার যাননি। কিন্তু আমি যখন একই পথের যাত্রী হলাম, এবং তার প্রাক্কালে স্যারের বাসায় গেলাম আলাপ করতে কী করব, স্যার বললেন, তুমি যাও, কারণ তোমার ইউনিভার্সিটিটা গ্রামে, সেখানে গিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে এই ধারণার জন্ম দাও যে এটা তাঁদেরই বিশ্ববিদ্যালয়। স্যারের এই উপদেশটি আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছিলাম।
মূলত স্যারের রাজনৈতিক চেতনাটি গ্রামীণ অর্থনীতিভিত্তিক। যখন দক্ষিণ এশিয়ার সমগ্র অঞ্চল বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে একটি অযৌক্তিক আচারসর্বস্ব জীবনকে ধর্মীয় কুসংস্কারের নামে মোক্ষলাভ হিসেবে দেখা হয়, সে জায়গায় স্যার চূড়ান্তভাবে বস্তুবাদী। পুঁজিবাদী সমাজকে শেক্সপিয়ারের ভাষায় যদি “ইউনিভার্সেল উলফ” বা মহাবৈশ্বিক নেকড়ে কিংবা মার্ক্সের ভাষায় “ডেড লেবার” বা রক্তচোষা পদ্ধতি বলা হয়, স্যার ঠিক এই বিশ্বাসে তাঁর মেধা বিকাশে ও জ্ঞান চর্চায় নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন। ১৯৭২-৭৫ সালে স্যার যখন আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন তখন তিনি শেক্সপিয়ারের নাটক রাজা লিয়ার পড়াতে গিয়ে লিয়ারের রাজ্য ভাগ, তাঁর বড় দুই মেয়ের লোভ, ছোট মেয়ের তাঁর প্রতি সহানুভূতি, এবং লিয়ারের নির্বাসন ও সাফারিংকে যুগান্তকারী শেক্সপিয়ার পণ্ডিত এ. সি. ব্র্যাডলির মতো চিরন্তন মানবতাবাদী ব্যাখ্যায় পরিস্কার করলেন না, কিংবা ক্রিশ্চিয়ান বিশ্বাসের প্যার্টান অনুযায়ী বলেননি যে নৈতিকভাবে কেউ ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তাঁকে সাফার করতে হবে, এবং সাফারিং-এর মাধ্যমে তাঁর দিব্যদৃষ্টির জন্ম হবে; না এমন কোন গতানগতিক বিশ্লেষণ-পাপ, যন্ত্রণা এবং সিদ্ধি-এই পথে স্যার গেলেন না, বরঞ্চ তিনি মার্ক্সীয় বস্তুবাদী দর্শনের আলোকে ক্লাসকে বোঝালেন, পুঁজিবাদী সমাজের মূল ঘাঁটি হলো লোভ, বস্তুর প্রতি লোভ, পার্থিব জগতের প্রতি লোভ, যেটিকে মার্ক্স কমোডিটি ফেটিশিজম বা রেইফিকেশন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বস্তুগত লোভের প্রথম শিকার হলো মানুষে মানুষে সম্পর্ক। যেমন লিয়ারের দুই বড় মেয়ে গনরিল ও রিগ্যান রাজ্যের লোভে বৃদ্ধ পিতাকে রাজ্যছাড়া করে। স্যার জানতেন, এই নতুন ধারার অর্থনৈতিক-ভিত্তিক আলোচনা হয়তো আমাদের বুঝতে ঝামেলা হতে পারে, সে জন্য তিনি প্রতিটি বাক্য সরল বা সিম্পল বাক্যে বলতেন, এবং দু’বার করে বলতেন। আমাদের নোট নিতে নিতে খাতা ভর্তি হয়ে যেত। স্যারের বলা বাক্যগুলো অনেকদিন আমার মনে ছিল।
স্যার একদিন বললেন, মোহীত, অনেকদিন তো সময় সাহিত্যপত্রিকাটি সম্পাদনা করলাম, এবার ভাবছি নিজেদের উদ্যোগে অনুরূপ একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করব। নাম দেব, সীমান্ত। আমি জানতাম যে “কাঁদিতে আসিনি, ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি” খ্যাত মাহবুব উল আলম চৌধুরী (অনেকে ওনাকে মোমেনের জবানবন্দী ও বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত-র লেখক সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের সঙ্গে গণ্ডগোল করে ফেলেন)ও সীমান্ত নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। আমি বললাম, স্যার, নামটা আমার পছন্দ হলো না, কারণ আপনিতো সীমান্ত টেনে দিলেন। কিন্তু মানুষের চিন্তাতো সানস ফ্রন্টিয়ার্স, বা সীমানাবিহীন। স্যার আমার কথা শুনলেন, তারপর যে সাহিত্য পত্রিকাটি বের করলেন সেটির নাম হলো নতুন দিগন্ত যেটি ত্রৈমাসিক এবং বর্তমানে নিরবচ্ছিন্নভাবে বের হচ্ছে গত তেইশ বছর ধরে।
নতুন দিগন্ত পত্রিকার সবচেয়ে সুপাঠ্য হলো স্যারের বিস্তৃত সম্পাদকীয়। স্যারের আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি অনাকর্ষিত হবার কারণগুলো প্রতিটি সম্পাদকীয়তে তাঁর রচনার নীচে নীচে পালিম্পসেস্টের মতো খুঁজে পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের রাজনীতির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে প্রাক-পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করে নিজের হতাশা বারংবার প্রকাশ করেছেন। ১৯৭২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লিখছেন: “১৯৭২-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের নির্বাচনে (ডাকসু) মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নই জয়ী হয়েছে। কিন্তু পরে তারা তাদের ম্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি; কারণ মূল সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি দ্রুত বেগে হাত মিলিয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে।” (নতুন দিগন্ত, পঞ্চদশ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ২০১৭, পৃ. ২৩।)
২০০০ সালে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত বাঙালীর জাতীয়তাবাদ স্যারের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারার একটি আকর গ্রন্থ। ধর্মীয় ঐক্যের দ্বারা যে জাতীয়তাবাদ নির্ণিত হতে পারে না, বরঞ্চ ভাষা ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট যে জাতীয়তাবাদ নির্দিষ্ট করে সে সম্পর্কে এই ব্ইটিতে বিশদ আলোচনা আছে। তবে, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্যার জাতীয়তাবাদ নির্দিষ্টকরণে শুধু ভাষাভিত্তিক ঐক্যের সীমাব্ধতার কথাও স্বীকার করেন, যদিও তিনি ফরাসী চিন্তক আর্নেস্ট রেনানের মতো পুরোপুরি বলেন না যে একটি জাতির টিকে থাকা নির্ভর করে ধর্ম, ভাষা, ভূগোল, ইতিহাস বা এমন কোন উপাত্তের ওপর নয়, বরঞ্চ একটি গ্রেট কনসেন্ট বা মহাসম্মতির ওপর।
আজকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে অতি-রাজনীতিকরণের বিষে ভুগেছে সে সম্পর্কে স্যার বহু আগেই মতামত দিয়েছেন: “. . . সেজন্য শাসকদের পক্ষে জরুরী ছিল আদর্শিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। সেটা করা হতো প্রলোভন, ভয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।” (পৃ. ১১৩)।
স্যারকে আমি আমার একটি বই, দেশ কোথায় আটকে আছে (বলাকা প্রকাশনী, ২০০৭), উৎসর্গ করেছিলাম। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলাম, “শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’কে / যাঁর স্নেহসিক্ত প্রশ্রয়ে আমার চিন্তা করার সাহস বেড়েছে।” ওমা, অবাক কাণ্ড, একদিন আমি ডাকযোগে স্যারের একটি নতুন বই পেলাম: বাংলা সাহিত্য ও বাঙালী মধ্যবিত্ত (গ্লোব লাইব্রেরী, ২০১১)। কয়েকটা পাতা ওল্টানোর পর আমার চক্ষু চড়কগাছ, দেখি বইটি আমাকে উৎসর্গ করা: “উৎসর্গ: মোহীত উল আলম / প্রীতিভাজনেষু।” আমার জীবনে একটি শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
স্যার বইটি আমাকে উৎসর্গ করে ঠিকই বক্রভাবে আমার শ্রেণিচরিত্র যেমন নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তেমনি বইটির পনেরটি প্রবন্ধের মধ্যে মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবননান্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসুসহ অনেককেই সামন্তবাদী চেতনার প্রতিভূ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ মধ্যবিত্তসুলভ সুবিধাবাদী চরিত্র এঁদের সবারই লেখায় পাওয়া যায় বলে স্যারের বিশ্বাস। “অবতরণিকা”য় বলছেন, “বাংলায় যেটা আবশ্যক ছিল সেটা হলো একটি সামাজিক বিপ্লব, যেটি ঘটলে দেশ অমন রক্তাক্ত ও সর্বনাশরূপে বিভক্ত হতো না, এবং পুঁজিবাদও প্রতিহত হতো। মধ্যবিত্ত সেটা চায়নি, বরঞ্চ নানাবিধ বিপ্লবের ধ্বনি তুলে এই বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে; মধ্যবিত্ত রচিত ও পঠিত সাহিত্যের কাজটাও ছিল এই বিপ্লবকে ঠেকানো, একে সাহায্য করা নয়।” (পৃ. ২২)।
এই একই বছরে (২০১১) স্যার কত মূল্য হইবে ইহার শীর্ষক বিদ্যাপ্রকাশ থেকে একটি বই প্রকাশ করলেন। কীসের মূল্য? মুক্তির মূল্য। এতে অর্ন্তভুক্ত দুর্দান্ত একটি প্রবন্ধ “অনেক কিছুই বদলায়, রাষ্ট্রের চরিত্র ছাড়া,” যেটিতে স্যার বলছেন যে বিরোধী কণ্ঠকে চেপে রাখাই হচ্ছে সব সরকারের উদ্দেশ্য। বহু আগে সরদার ফজলুল করীম বলেছিলেন, স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু জনগণের মুক্তি আসেনি।
স্যারের অবস্থান থেকে স্যার জাতির এই শারীরিক এবং মানসিক মুক্তির জন্য সমাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আজকে তাঁর ৮৯তম বছর পূর্ণ হলো। এখনও তিনি তাগড়া যুবক।
স্যার আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়ও রইলো।