ধুকছে জনবল সঙ্কট ও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের অভাবে #
ভূঁইয়া নজরুল :
৬৫ বছর বয়সী আবদুর রব চৌধুরী চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে করোনা উপসর্গ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৫টা ৪৫ মিনিটে ভর্তি হন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই মারা গেলেন পরদিন দুপুর একটায়। এর আগে গত মঙ্গলবার ৬৫ বছর বয়সী অর্ধেন্দু দে করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান। প্রায় প্রতিদিনই এধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে। চট্টগ্রামের সবেধন নীলমনি এই হাসপাতাল ছাড়া করোনা এবং করোনা উপসর্গের মুমুর্ষ রোগীদের অন্য কোথাও আইসিইউ’র তেমন সুবিধা নেই। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চারটি আইসিইউ শয্যা সম্প্রতি চালু করা হলেও এই হাসপাতালে রয়েছে ১০টি আইসিইউ শয্যা। হাসপাতালটিতে আইসিইউ সেবা চালুর ৫০ দিনে (২৪ এপ্রিল থেকে ১৩ মে পর্যন্ত) এপর্যন্ত ৪৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো।
কেন এত মৃত্যু ঘটছে?
বেশিরভাগ রোগীর অভিভাবকদের অভিযোগ, আইসিইউতে নেয়ার পর রোগী বেশিক্ষন টিকে না। গত জুন বিকাল চারটায় আইসিইউতে মারা গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নগর পরিকল্পনাবিদ সরোয়ার উদ্দিন আহমেদ। এবিষয়ে সরোয়ার উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বলেন,‘ আমার স্বামীর মৃত্যুর আগের দিন পুরো রাত আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আইসিইউতে নেয়ার ২৬ ঘন্টার মধ্যে তিনি মারা গেলেন। অথচ মারা যাওয়ার চার-পাঁচ ঘন্টা আগেও তিনি সুস্থ ছিলেন বলে জেনেছি। আইসিইউ সাপোর্ট থাকার পরও কেন শ্বাসকষ্টে মারা যাবে তা বুঝে আসছে না।’ এর আগে এই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার একদিন পরেই গত ২২ মে মারা গিয়েছিলেন দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ এসআলমের পরিচালক মোরশেদুুল আলম।
করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৫ শতাংশ রোগী মুমূর্ষু হয়ে থাকে। এসব রোগীদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্টের সমস্যা, উচ্চরক্তচাপ ও শ্বাসকষ্ট রয়েছে তারা করোনায় ঝুঁকিপূর্ণ এবং এধরনের রোগীদের মৃত্যু হার বেশি। জেনারেল হাসপাতালে মারা যাওয়া বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এই চিকিৎসকদের তথ্যের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। তবে তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায় জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ সেবা কি পর্যাপ্ত পাচ্ছে রোগীরা?
জনবল সঙ্কটে ধুকছে আইসিইউ
জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একটি আইসিইউ ইউনিট পরিচালনার জন্য প্রতি শিফটে চারজন করে তিন শিফটের জন্য ২৪ জন চিকিৎসক প্রয়োজন, কিন্তু আছে মাত্র ১২ জন। একইসাথে প্রতি শিফটের জন্য ২০ জনে করে নার্সের প্রয়োজন হলে তিন শিফটের জন্য প্রয়োজন ৬০ জন, কিন্তু রয়েছে ৩৬ জন। অপরদিকে সম পরিমান ওয়ার্ডবয়ের প্রয়োজন হলেও নার্সের অর্ধেকও নেই। এবিষয়ে হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক এবং বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, জনবলের জন্য আমরা চাহিদাপত্র দিয়েছি কিন্তু এখনো পাইনি। জনবল না পাওয়ায় অবশ্যই চাহিদামতো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, একটি রোগীকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানোর জন্য যেখানে এক মিনিটের মধ্যে সম্ভব, কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় তা অনেক সময় পাঁচ মিনিটেও সম্ভব হচ্ছে না। আইসিইউর রোগীগুলো খুবই মুমূর্ষু অবস্থায় থাকে, তাই তাদেরকে যতো দ্রুত সার্ভিস দেয়া যায় ততোই মঙ্গল।
এই হাসপাতালের করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, এখানে ডাক্তারদের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। ডাক্তাররা টানা কাজ করতে পারে না। তাই যতো বেশি ডাক্তার, নার্স ও ওয়ার্ডবয় পাওয়া যাবে চিকিৎসা সেবাও ততোবেশি ভাল হবে।
রয়েছে হাইস্পিড অক্সিজেন সরবরাহের অভাব
করোনা চিকিৎসায় এবং শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হাইস্পিডে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা। আর আইসিইউ ইউনিটের জন্য এই সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম প্রয়োজন থাকলেও করোনা চিকিৎসায় একমাত্র (সবচেয়ে বেশি আইসিইউ ১০টি) এই হাসপাতালটি থাকলেও এখানে নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন। এবিষয়ে হাসপাতালটির সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, অক্সিজেন ফ্লো বাড়ানোর জন্য হাই নজল ক্যানোলা প্রয়োজন। আমাদের এখানে দুটি রয়েছে। তবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন থাকলে রোগীরা দ্রুত অক্সিজেন পেয়ে থাকে।
সেন্ট্রাল অক্সিজেন না থাকায় সিলিন্ডার দিয়ে অক্সিজেন চাহিদা মেটানো হয় জানিয়ে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম চালু করার জন্য একটি আবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে। কিন্তু এখনো অনুমোদন পায়নি। আর এটি চালু করা গেলে আইসিইউ রোগীরা সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেতো।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, মা ও শিশু হাসপাতাল এবং ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে শুধুমাত্র সেন্ট্রাল অক্সিজেন সুবিধা রয়েছে। আর কোনো হাসপাতালে এই সুবিধা নেই।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে দিন দিন বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। গতকাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৮১৫ জন ছিল আক্রান্তের সংখ্যা। কিন্তু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউ সেবা নেই। প্রতিদিন আইসিইউর অভাবে মরছে মানুষ। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও সঠিকভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে না। এছাড়া করোনা চিকিৎসার জন্য দুটি হাসপাতালকে সরকার নির্ধারণ করে দিলেও তা এখনো চালু হয়নি। তাই মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ। কিন্তু এখানেও রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। গত ২৫ এপ্রিল থেকে হাসপাতালটিতে আইসিইউ সেবা চালু হয়।