মূল গল্প : দ্য ফাইভ বুন্স অফ লাইফ
লেখক : মার্ক টোয়াইন
অনুবাদ : ফারহানা আনন্দময়ী :
জীবন-আকাশে যখন একটু একটু করে ভোর ফুটছে, একটা পরি এসে দাঁড়ালো। তার জীবনের সামনে। পরির হাতে উপহারের একটা ডালি।
বললো, ‘এখানে অনিন্দ্যসুন্দর কিছু উপহার আছে তোমার জন্য। একটা বেছে নাও। চিন্তাভাবনা করে, খুব সতর্কতার সাথে একটা পছন্দ করো। একটাই নেবে। এদের মধ্যে একটাই সবচেয়ে মূল্যবান’।
খ্যাতি, ভালোবাসা, বিত্ত, আনন্দ আর মৃত্যু… এই পাঁচটি উপহারই ওই ডালিতে ছিল। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে, তার তারুণ্য উত্তর দিল, ‘অন্য কোনো কিছুই আর ভাবতে হবে না। অবশ্যই আমি ‘আনন্দ’কে চাই’।
সে এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের পৃথিবীর আনন্দ সন্ধানে বের হলো। খুঁজে পেল আনন্দের সব উপকরণ! কিন্তু কিছু সময় পরে তার উপলব্ধি হলো, সমস্ত আনন্দই ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর, শূন্য। সকল আনন্দই তাকে হতাশ করে ফিরে গেল। বেদনার্ত হৃদয় নিয়ে সে ভাবতে লাগলো, ‘জীবনের এই সময়টা আমি একেবারেই অপচয় করে ফেললাম। আমাকে আবার যদি কিছু বেছে নিতে বলা হতো, এবার আর ভুল হতো না’।
পরিটি তার সামনে ফিরে এলো। বললো, ‘এখনো সুযোগ আছে। আরো চারটি উপহার বাকি রয়ে গেছে ডালিতে। এবার কিন্তু তুমি বেছে নিতে ভুল কোরো না। ভাবো, গভীরে গিয়ে ভাবো। তারপর নাও’।
অনেকক্ষণ ধরে ভাবলো লোকটি। ভেবেচিন্তে, বেছে নিল ‘ভালোবাসা’কে। তার উপহার নিয়ে সে এতটাই মগ্ন ছিল, খেয়ালই করলো না, উপহারটা দেবার সময়ে পরির চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমে ছিল।
অনেকগুলো বছর এরমাঝে কেটে গেল। একদিন তার নিজের বাড়িতে একটা কফিনের সামনে সে বসে ছিল বিষণœ মনে। নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন চলছিল।
সে বললো, “একে একে সকলে আমাকে ছেড়ে গেল। সবশেষে যাকে ভালোবেসেছিলাম, সে-ও এখন আমার সামনে এই কফিনে শুয়ে আছে। অন্তিমযাত্রা পথে সে। সকল বিদায়, সবার চলে যাওয়া আমাকে কেবল শূন্যতাই দিয়ে গেল। যা কিছুকে ভালোবেসেছি, তারা আনন্দ দিলো ঠিকই। কিন্তু যখন আমাকে ছেড়ে গেল, সেই যন্ত্রণা সীমা ছাড়ানো। আনন্দের শেষে গিয়ে প্রতিবারই আমাকে বেদনার স্বাদ পেতে হয়েছে। হৃদয়ের গভীর থেকে আমি এদের সকলকে অভিশাপ দিই”।
পরিটি আবার এলো। “আবার সুযোগ দিলাম। বেছে নাও। এত বছরে তুমি জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছ নিশ্চয়ই। কোন্টা ভালো, কোন্টা মন্দ, সে বিবেচনাবোধ এতদিনে তোমার এসেছে। তিনটা উপহার বাকি আছে আর। এর মধ্যে একটা সেই মূল্যবান উপহার। খুব সতর্কতার সাথে বেছে নিয়ো”।
লোকটা সময় নিলো, বেশ কিছুক্ষণ। ‘খ্যাতি’কে নিজের করে নিলো এবার। উপহারটা দিয়ে যেতে যেতে একটা দুঃখশ্বাস রেখে গেল সেই পরি।
কয়েক বছর পরে সে আবার ফিরে এলো লোকটার কাছে। একটা শূন্য ঘরে, খুব মন খারাপ করে একা বসে ছিল লোকটা। কিছু বিষাদী ভাবনা তার মনটা ঘিরে ছিল। পরিটা ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ভাবনাটা মনের কানে শুনতে পেল যেন।
‘আমার খ্যাতি সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে গেল। সকলেই শুধু আমার কীর্তির প্রশংসায় ভরিয়ে ফেললো। ওদের মুগ্ধতা! আহা! কী আশ্চর্য সুন্দর সেই দিনগুলো! কিন্তু সেই মুগ্ধতার ক্ষণ কী ভীষণ স্বল্প! ধীরে ধীরে ঈর্ষা এসে তাকে গ্রাস করলো। প্রশংসার বদলে তারা সমালোচনার নামে নিন্দে করতে শুরু করলো আমার। খ্যাতির ক্ষয় দেখাটা খুবই বেদনার। নিন্দা, কুৎসার শেষে গিয়ে সেটা একসময় করুণায় রূপ নিলো। সুনামের গায়ে কেবলই ছিটে এসে লাগতে লাগলো দয়া আর করুণার কাদা। খ্যাতির শীর্ষে উঠে এমন দুঃখজনক পতন; বিষময় করে তুললো আমার জীবনকে’।
তার বেদনাকে ছুঁতে পারলো সেই পরি। বললো, ‘আর মাত্র দুটো উপহার বাকি আছে। সেই মূল্যবান উপহারটি এখনো রয়ে গেছে কিন্তু। এবার অনুগ্রহ করে আর ভুল কোরো না’।
‘আমি কী বোকা রে! ডালিতে ‘বিত্ত’ রয়ে গেছে! হ্যাঁ, আমি ‘বিত্ত’ই চাই। ‘বিত্ত’… সকল ক্ষমতার মূল’। লোকটি বললো, ‘এবার আমার জীবন পরিপূর্ণ হবে। শুধু খরচ করবো, মন যা চায় তাই-ই কিনবো। যারা আমাকে দয়া দেখিয়েছিল, তাদের ঈর্ষা এবার আরো বাড়বে। আমি এক বিলাসি জীবন যাপন করবো; সকল আনন্দ, সকল শখ…সব, সব এবার আমার হাতের মুঠোয় আসবে। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই! সকলের সম্মান, স্তুতি, সমীহ… সব এখন চাইলেই পেতে পারি আমি! এতদিন অযথা সময়ের অপচয় করেছি। ভুল নির্বাচনে আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় চলে গেল! এই উপহারটা আমি অনেক আগেই বেছে নিতে পারতাম! ভুল করেছি’।
এরপরে আর মাত্র তিনটা বছর গড়ালো। লোকটি ছোট্ট একটি জীর্ণ ঘরে নিঃসঙ্গ বসা। অপার দুঃখবোধ তার ভাবনার চারপাশ ঘিরে! তার চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, হলুদ-পাংশুটে! ছেঁড়া একটা জামা গায়ে, শুকনো রুটি চিবোচ্ছিল বসে বসে।
‘আমি কী ভুলই না করেছি জীবনভর! মূল্যবান মনে করে যা যা উপহার আমি বেছে নিয়েছিলাম, ত্রা আসলে কোনোটারই মূল্য নেই। সবকিছুকে আমি অভিশপ্ত মনে করি। আনন্দ, ভালোবাসা, খ্যাতি আর বিত্তর মতো ক্ষণস্থায়ী আর কিছু নয়। এরা ক্ষণকাল পরে যন্ত্রণা, বেদনা, লজ্জা আর দারিদ্র রেখে যায়, বাকি জীবনের জন্য। সেই পরিটা ঠিকই বলেছিল, ও-ই সত্য বলেছিল। উপহারগুলোর মধ্যে একটাই ছিল কেবল অমূল্য। বাকিগুলো ছিল মূল্যহীন। আমার চিন্তাভাবনায় কী দীনতাই না ছিল! যে উপহারটা আমাকে চিরকালীন শান্তি দিতে পারতো, সেটাই আমি ফেলে রেখেছিলাম। যা আমাকে এক অন্তহীন স্বপ্নে ডুবিয়ে রাখতো পারতো, তাকে আমি বেছে নিইনি। যে লজ্জা আর বেদনা আমার শরীর-মনকে তিলে তিলে ক্ষয় করে ফেলেছিল, একমাত্র এই উপহারটাই তাকে উপশম দিতে পারতো। আমি চাই, সেটাই আমি এখন চাই। আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। বিশ্রাম চাই আমি এখন’।
সেই পরিটি শেষবারের মতো এলো এবার, সাথে সেই চারটি উপহার। কিন্তু নেই! সেখানে ‘মৃত্যু’ নামের সেই উপহারটি ছিল না; লোকটি শেষপর্যন্ত যেটা চাইলো।
‘একটা ছোট শিশুকে আমি সেটা দিয়ে এসেছি। সে নিষ্পাপ আর আমার ওপরই ভরসা রেখেছিল। আমিই তাকে বেছে উপহারটি দিয়ে এলাম। তুমি তো আমার পছন্দের প্রতি ভরসা রাখোনি’। পরিটা স্থির কণ্ঠে লোকটিকে বললো।
‘কী শাস্তি আমার! তাহলে কী আর আছে আমার জন্য’?
‘যা তুমি চাইলেই এড়াতে পারতে! তোমার জন্য অপেক্ষা করছে জরাপূর্ণ একটি অন্তহীন বার্ধক্য’!