জোবায়ের রাজু
ডাক্তার সোলায়মান রেশমাকে বলে দিয়েছেন শ্বাসকষ্টের ঔষধ একদিনও মিস করা যাবে না। তিনবেলা করে ইনহেলার নিতে ভুল যেন না হয়। ভুল রেশমার ঠিকই হয় না। তারপরও সে মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ইনহেলার ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। এতে করে তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়, তখন আজিম রাগী গলায় বলে, ইনহেলার নিতে তোমার সমস্যা কি? রেশমা জবাব দেয় না। স্বামীর আয়-রোজগারের কথা চিন্তা করে ইনহেলারে চাপ দেওয়ার দুঃসাহস হয় না তার। একটা ইনহেলারের যে মূল্য, ওটা জোগাতে আজিমকে কি পরিমাণ বেগ পোহাতে হয়, সেটা মুখে না বললেও রেশমা ঠিকই টের পায়। স্বামী যে তাকে জীবন দিয়ে ভালবাসে, সেটাও টের পায়। তাই নিজেকে পরম ভাগ্যবতী মনে হয় তার। কিন্তু রোজদিনের অভাবের কাছে তার সেই ভাগ্যবতী জীবন বড় পানসে যেন। নদী ভাঙনের পর এতিম আজিম তার ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারানোর পর একেবারে পথেই বসে গেল। রেশমাকে নিয়ে চলে আসে রামায়ণপুর। ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে গড়ে নিয়েছে পেশাদারিত্ব। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগে ভ্যানটি চুরি হয়ে যায়। নতুন করে ভ্যান কেনার পয়সা তার পকেটে নেই। এদিকে রেশমার শ্বাসকষ্টের ওঠানামা দারুণ দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল আজিমকে। সে ঠিক করেছে রেশমার পোষা মুরগিগুলো থেকে একটি মুরগি বাজারে নিয়ে বিক্রি করে যে পয়সা পাবে, সেটা দিয়ে রেশমার জন্য একটা ইনহেলারের ব্যবস্থা করে ফেলবে। কিন্তু রেশমা যে তার শখের পোষা মুরগি বিক্রি করতে আপত্তি জানাবে, সেটা আজিম সুনিশ্চিত। তাই রেশমাকে না জানিয়ে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে বড় সাইজের লাল মুরগিটা কৌশলে ধরে এনে গঞ্জের হাটের দিকে রওনা দেয়।
হাটে এসে দেখে আজ হাট লোকে লোকারণ্য। স্বস্তি পেল আজিম। এত লোকের মধ্যে কেউ না কেউ তো অবশ্যই তার মুরগিটা কিনতে এগিয়ে আসবে। এসব ভাবনা যখন আজিমের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তখনই ঘটলো বিপত্তিটা। বেখেয়ালে আজিমের হাত থেকে ফসকে মুরগিটা হাতছাড়া হয়ে যায়। হায় হায়, সর্বনাশ! কি হবে এখন! চোখের সামনে দিয়ে মুরগিটা দৌড়াতে থাকে সামনের দিকে। আজিমও মুরগিটাকে টার্গেট করে পেছন থেকে দৌড়াতে থাকে ধরে ফেলার আশায়। কিন্তু আজিমের ভাগ্য সহায় হয় না। তার আগেই হেলমেটে মাথা ঢাকানো টগবগে এক তরুণের ধেয়ে আসা বাইকের চাকার তলে থেঁতলে গিয়ে প্রাণ হারায় আজিমের বিক্রি করতে আনা শখের মুরগিটা, যেটা বিক্রি করে সে রেশমার জন্য ইনহেলার কেনার ব্যবস্থা করবে ভেবেছিল। অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটি দেখে স্তব্ধ হয়ে যাবার আগেই আজিম দেখল, দুরন্ত বাইক আরোহী তরুণটি উল্কার বেগে চলে গেল মুরগি অ্যাক্সিডেন্টের জরিমানা দেওয়ার ভয়ে। চোখের সামনে মুরগিটি ছটফট করতে-করতে মারা গেল লাল রক্তের ওপরে। আজিম শুধু চেয়ে রইল মরা মুরগিটির দিকে। যে দৃশ্য বড় বেদনার।
২.
সন্ধ্যার আবছায়া গায়ে মেখে বাড়ি ফিরে আসে আজিম। চকিতে শুয়ে শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছে রেশমা। রুগ্ণ স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারছে না আজিম। সংসার পাতার পর থেকে এই নারীকে সে সুখ দিতে পারেনি বলে আত্মগ¬ানি নিয়ে উঠোনে চলে আসে। জোনাকিরা মেতে আছে এই সন্ধ্যার আঁধারে। খোঁয়াড়ে মোরগগুলো অকারণে ডাকাডাকি করছে। কাল ভোরে রেশমা যখন খোঁয়াড়ের দুয়ার খুলে দিয়ে তার পোষা লাল মুরগিটি দেখতে না পেয়ে বড্ড আফসোস করবে, সে দৃশ্য সইতে পারবে না আজিম। বাইকের চাকার তলে পড়ে যাওয়া সেই মুরগির জন্য যতখানি কষ্ট হচ্ছে আজিমের, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে রেশমার জন্যÑ কিনতে না পারা ইনহেলারটার জন্য।