শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
হালকা বৃষ্টিতেই হাঁটু সমান পানি ওঠে যাওয়ায় নগরবাসীকে পোহাতে হয় দুর্ভোগ। এ দুর্ভোগ লাঘবে ২০১৭ সালে সরকার বড় পরিসরে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প হাতে নেয়। এরপর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দুইটি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট চারটি প্রকল্প শুরু করে।
সম্প্রতি হওয়া বৃষ্টিতে দেখা গেছে, নগরের চকবাজার, ষোলশহর, ২ নম্বর গেট, শুলকবহর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, ডিসি সড়ক, পাঠানটুলি, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা ও বহদ্দারহাট এলাকায় পানি জমে যায়। হাঁটু সমান পানিতে দুর্ভোগে পড়েন নগরের নিচু এলাকার মানুষেরা।
আসন্ন বর্ষায় জলাবদ্ধতা সংকট নিয়ে কথা হয় চলমান চারটি প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী তিনটি সংস্থার সঙ্গে। সংস্থার দায়িত্বশীলদের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে একনেকের অনুমতি পেয়ে পতেঙ্গার ১৫ নম্বর ঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ১২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধক দেওয়াল নির্মাণের কাজসহ ২৩টি রেগুলেটর বসানোর প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তিতে প্রকল্প থেকে বাদ পড়েছে পতেঙ্গার ১৫ নম্বর ঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত দেওয়াল নির্মাণের কাজ। ফলে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা থেকে প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রকল্প ব্যয় কমেছে। কালুরঘাট থেকে হালদা অংশে চারটি রেগুলেটর বসিয়ে এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ২৫ শতাংশ। ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পে চসিকের অগ্রগতি ৩৮ শতাংশ। দুই হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে সিডিএর অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ এবং পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ।
এছাড়াও গত ৩০ মার্চ চসিক খাল ও নালা থেকে আবর্জনা ও মাটি অপসারণে নিয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে দুই মাসের মধ্যে, অর্থাৎ বর্ষার আগে। তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৩৬টি খালের বাঁধ অপসারণের কাজ শেষ হওয়া জরুরি। আর তা আগামী রোববারের মধ্যে শেষ হওয়ার আশ্বাস দেন চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী।
তিনি জানান, ‘জলাবদ্ধতা প্রকল্প নিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারিতে সিডিএ একটি সমন্বয় সভা করে। ওই সভায় ৩০ মার্চের মধ্যে খালের বাঁধ অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা প্রায় খালের বাঁধ সরিয়ে নিয়েছি। আর কয়েকটি খালের বাঁধ সরানোর কাজ বাকি আছে। এগুলো দুই-তিন দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় মরিয়মবিবি, কলাবাগিচা, টেকপাড়া, ফিরিঙ্গিবাজার ও মহেশখালের মুখের রেগুলেটর চলতি বর্ষা মৌসুমের আগেই কার্যকর করা যাবে। সুতরাং, এবারের বর্ষায় খালে পানি যাওয়া নিয়ে কোনো দুঃশ্চিন্তা থাকবে না। তবে ড্রেন-নালায় যদি কোনো আবর্জনা আটকে থাকে, সেটি দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে।’
প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতা আছে, তবে প্রকল্পের কাজ থেমে নেই। বর্তমানে এই প্রকল্পের পাঁচটি স্লুইস গেটের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। নগরীর যে ৩৬টি খাল পুনরুদ্ধার কাজ করছি, সেখানের ২০টি খালের কাজ শেষ করেছি। সেগুলোর দু’পাশে সর্বমোট ১৭৬ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ এবং খালের দু’পাড়ে ১৫ ফুট প্রশস্ত রাস্তা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে একশ কিলোমিটারেরও বেশি রিটেইনিং ওয়ালের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর মির্জাখাল, ত্রিপুরাখাল, গয়নাছড়া খাল, ডোমখালী খাল, মহেশখাল, চাক্তাইখাল, চাক্তাই ডাইমেনশন খাল, হিজড়া খাল, বদরখাল, নোয়াখাল, শিতলঝর্ণা খাল, চশমাখালসহ ১৬টি খালের খনন, সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ বাকি রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা কেটে গেলেই কাজ শুরু হবে।’
নগরের খালের বাঁধ অপসারণের পরও নালার আবর্জনার কারণে জলজট সৃষ্টির প্রসঙ্গিকতা নিয়ে কথা হয় চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহরের কাউন্সিলর মো. মোবারক আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘খালের বাঁধ অপসারণে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে খালের বাঁধ অপসারণের কাজ শেষ হবে। এরমধ্যে সিটি করপোরেশন ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পে নালা ও খালের মাটি ও আবর্জনা তোলা হবে। এতে ৫টি স্কেভেটর কাজ করবে। আর যেসব জায়গায় স্কেভেটর দিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়, সেখানে ম্যানুয়ালি কাজ করা হবে। আশা করছি, আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা অনেকটুকু কমে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মুরাদপুর এলাকায় ও ত্রিপুরা খালে কাজ চলছে। দুইটি কাজই আমার এলাকায়। কাজগুলো শেষ হলে দীর্ঘমেয়াদে আমরা সুফল পাবো।’
চসিকের ২০১৪ সালের ২৪ জুন নগরীর বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। প্রায় সাত বছর পর গত বছরের ২৭ নভেম্বর প্রকল্পটি উদ্বোধন হয়। এ নিয়ে প্রকল্পটির পরিচালক ও চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম বলেন, ‘২৫ একর জমির মধ্যে জেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত ১০ একর বুঝিয়ে দিয়েছে। মোট ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯১৪ কোটি টাকা। এখন যে অংশটুকু আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই অংশের কাজ চলছে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৩৮ শতাংশ। এরমধ্যে ছোট কালভার্ট ও খাল খননের কাজ দৃশ্যমান।
কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তাবায়ন করছে সিডিএ। ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর শুরু হওয়া প্রকল্পটির অগ্রগতি নিয়ে কথা হয় সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটির দীর্ঘদিন সময় লেগেছে আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে। তবে এখন প্রকল্পের কাজ ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। এতে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউজ স্থাপনের কথা রয়েছে। এরমধ্যে ১০টি খালের কাজ চলছে। আগামী বছরের জুনে কাজটি শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি।
বাপাউবো চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে শাহীদ বলেন, ‘পতেঙ্গার ১৫ নম্বর ঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ১২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার একটি দেওয়াল নির্মাণের কথা ছিলো। তবে ওটা বন্দরের এলাকায় হওয়ায় সেটি আর হচ্ছে না। তবে আমরা দেখেছি, এ দেওয়ালটা করতে না দিলেও তারা জায়গাটি তাদের মতো বেশ উঁচু করেছে। তাদের কাজগুলো তাদের নিয়মে চলছে। পাশাপাশি আমরাও বিবেচনা করেছি, আমাদের কাজের জন্য জাহাজ ভেড়ানো ও পণ্য পরিবহনে যেন কোনো সমস্যা না হয়। তাই ওই অংশটি বাদ দিয়ে আমরা কালুরঘাট থেকে হালদার অংশ পর্যন্ত বাঁধ দিচ্ছি ও ২৩টি রেগুলেটর বসাচ্ছি। এ কাজও বাস্তবায়ন করছেন সেনাবাহিনীর ইসিবি। এরমধ্যে আমাদের চারটি রেগুলেটর এ বর্ষায় অপারেশনে যাবে। অন্য একটি রেগুলটর বসানোর কাজ হচ্ছে গুপ্তখালে।’