আ.ফ.ম.মোদাচ্ছের আলী »
চট্টগ্রাম এর মেয়র একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক। আমার জানা মতে তাঁর লেখা ১৩ থেকে ১৪ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত আজ যেই লেখাটির অবতারণা করতে যাচ্ছি সেই কাজটি এগিয়ে দিয়েছেন বিদায়ী মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। তথাকথিত বিপ্লব উদ্যানে তিনি ‘জয় বাংলা’ উৎকীর্ণ করেছেন। তবে দুই মেয়রকেই আমি বইমেলার প্রস্তুতি সভায় এটিকে জয় বাংলা উদ্যান ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছি সকলের সম্মুখে তথ্য উপাত্ত দিয়ে। কিন্ত হা হতোস্মি।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে জ্বলে উঠেছিল চট্টগ্রাম। সোয়াত জাহাজে করে গণহত্যার জন্য অস্ত্র খালাসে বাঙালি অফিসারকে বাধা দিয়েছিল চট্টগ্রামবাসী। এই বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা কমান্ডার, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সিরু বাঙালি লিখিত আলোচিত বই ‘সেনাপতির মুক্তিযুদ্ধ ছিনতাই’ বইটির নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। প্রাসঙ্গিকভাবেই এইবার আরো একটু পেছনের ইতিহাসে ফিরে যাই। ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে দৈনিক পূর্বকোণ এর মূলধারা বিভাগে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। এটি ১৪৫ কিস্তিতে শেষ হয় ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে। ১৯৯৬ সালে লেখাগুলো সংকলিত করে চট্টগ্রামের শৈলী প্রকাশন’ ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’ বইটি প্রকাশ করে। সিরু বাঙালির লেখা পূর্বকোণে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিচারণে লেখা হয় ১৯৬৯ সালের শেষ দিক থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা ষোলশহর সি ডি এ গোডাউনে (বর্তমানের শপিং কমপ্লেক্স) অবস্থান করেছেন। যার অন্যতম অফিসার ছিলেন মেজর জিয়া। ৮ম বেঙ্গল এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া ২৫ মার্চ রাত ১১ টায় মেজর জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তান নেভির একটি ট্রাকে একদল অবাঙালি পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর সাথে এম ভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের তদারকির জন্য বন্দরে পাঠান। এ প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ’ ৯ নম্বর গ্রন্থের ৪২ পৃষ্ঠায় মেজর জিয়াউর রহমানের বক্তব্য ছিল’ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় জানজুয়া নিজে এসে তাকে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোলশহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করে দেন। কিন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড সরিয়ে দিতে তার দেরি হচ্ছিল। আগ্রাবাদে যখন একটি বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তার ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে তখনই পেছন থেকে ছুটে আসে একটি ডজ গাড়ি। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে আসেন মেজর জিয়ার কাছে। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার ধারে। বলেন পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরে বহু লোক হতাহত হয়েছে। এখন কি করবেন? মাত্র আধা মিনিট চিন্তা করে জিয়া বলে উঠলেন উই রিভোল্ট? ‘(বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল পৃষ্ঠা ১৩৬)। আমার প্রশ্ন বিপ্লব কোথায় হলো? কিভাবে হলো? এবার দেখা যাক ৮ম বেঙ্গলের অন্যতম সিনিয়র বাঙালি অফিসার মেজর মীর শওকত আলীর বক্তব্য যা ছাপা হয়েছে ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ বইতে। বক্তব্যটি ছিল ‘২৫শে মার্চ ৭১ রাতে ঢাকার হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর পরই আমরা ভেবে দেখলাম যে, নতুন পাড়া ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ট্যাংক ছিল। আমরা ছিলাম ষোল শহরে মাত্র দু’ মাইল দূরত্বে। আমাদের হাতে কোন ট্যাংক ছিল না। ৮ম বেঙ্গল পাকিস্তানে চলে যাবে। তাই ভারি সব অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল আগেই। আমাদের হাতে ছিল কিছু রাইফেল ও এল এম জি জাতীয় অস্ত্র। আমি আর মেজর জিয়া আলাপ করে দেখলাম, আমরা যদি ষোলশহর বিল্ডিং এর ভিতর থাকি, এই অবস্থায় যদি ট্যাংক আসে, ট্যাংক থেকে দু’তিনটি গোলা ছুড়লেই আমাদের অনেক সৈন্য মারা যাবে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ষোল শহর স্টেশন ত্যাগ করে আমরা কোথাও নিরাপদ স্থানে হেড কোয়ার্টার বেস বানাবো। তাছাড়া আমাদের শপথ নেয়াও জরুরি। এরপর আমরা ভোর রাতের দিকে কালুরঘাটের দিকে মার্চ করে চলে গেলাম।’ পাঠক লক্ষ্য করুন কোথায় বিপ্লব হলো?। কে বিপ্লব করলো? বিষয়টির অবতারণা এখন জরুরি। ইতিহাস বলে চট্টগ্রামের প্রথম প্রকাশ্যে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দানকারী সেনা অফিসারটির নাম ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। সিআরবি পাহাড়ের উপর রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবের পশ্চিম দিকে দোতলা একটি কাঠের বাংলোতে স্থাপিত হয়েছিল ক্যাপ্টেন রফিকের অস্থায়ী সদর দফতর। সেখানে ইপিআর বাহিনীর সেনারা মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে পরিখা খনন করে পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন ইপিআর বাহিনীর বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম।
একটি দল ৭ মার্চ পালন করে নতুন করে ইতিহাস বিকৃতির খেলায় নেমেছে। বলেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ এর ভাষণ এ কোন দিকনির্দেশনা ছিল না। একটি দেশের (পাকিস্তানের) ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে যখন কোন জাতির নেতা লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে বলে দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’, বা ’ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর (পাকিস্তানের) মোকাবেলা করতে হবে’ তাইলে এর চেয়ে আর কী দিক নির্দেশনা প্রয়োজন ছিল? চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যান ও ইতিহাস বিকৃতির একটি অংশ। মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীনেই চাকুরি করেছিলেন। যেহেতু এই অংশে আমাদের ৮ম বেঙ্গলের বীর সেনারা অনেকদিন ছিলেন তাই এটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘জয় বাংলা’ উদ্যান ঘোষণা করা হোক। ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে নিস্কৃতি পাক ইতিহাস সৃষ্টির চট্টগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায়, অথচ চট্টগ্রামের মেয়ররা এই কাজটি করতে কেন পারছেন না বা পারলেন না তা ভাবনার বিষয়।
লেখক: ছড়াকার, শিশু সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক,সদস্য সচিব মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি ট্রাস্ট চট্টগ্রাম বিভাগ