হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলাই সমস্ত হাম্দ ও সানার মালিক, যিনি জান্নাতের মূল্যে মুমিনদের জান ও মাল খরিদ করেছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, যিনি তার বান্দাদেরকে যে কোন অপবিত্র বস্তু গ্রহণ করতে বারণ করেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় অবনত হই, যিনি সংক্ষিপ্ত জীবন ও স্বল্প মালের বিনিময়ে অমূল্য নেয়ামত ও চিরস্থায়ী জান্নাতের প্রতিদান দিয়ে থাকেন।
আমরা সর্বান্তকরণে সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই ও সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা, তাঁর রাসূল। আল্লাহ্ ¯্রষ্টা, নবী তাঁর সৃষ্টি। আল্লাহ্ উপাস্য, নবীজি উপাসক। নবীর হায়াত এবং ওয়াফাত আছে, আল্লাহ্ চিরস্থায়ী, অবিনশ্বর।
ক্ষণস্থায়ী এ পার্থিব জীবনের সমগ্রটাই আমরা শুধু ভোগÑলিপ্সায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকতে চাই। যদিও ভোগÑউপভোগের স্থিতি খুবই স্বল্প ও সংক্ষিপ্ত। বহু লোক অর্থÑবিত্ত ও ভোগ সামগ্রীর স্তূপ সঞ্চয়ে জীবনের অধিকাংশই ব্যয় করে। যখন সম্পদের স্তূপ পাহাড়সম হয়ে ওঠে, তখন নিজেরও ভোগের সামর্থ থাকে না। তখন তার ভোগ স্পৃহার সবটুকুই সঞ্চিত হয় কেবল চোখে। মরীচিকার পেছনেই আমরা ছুটতে থাকি আজীবন। অথচ আল্লাহ্ তাআলার ইরশাদ হল, ‘তোমরা তো দুনিয়ার (অনিশ্চিত ও ক্ষণস্থায়ী) জীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকো, অথচ পরকালের (স্থায়ী সুখের) জীবন উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী’। (৫৭:১৬-১৭) মহান রাব্বুল আলামীন অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মুসলমানদের কাছ থেকে তাঁদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন এ মূল্যে যে, তাঁদের জন্য বিনিময় জান্নাত। তাঁরা আল্লাহ্র রাস্তায় (নিজ নিজ জান ও মাল দিয়ে) শত্রু নিধন করবেন এবং (প্রয়োজনে) আত্মোৎসর্গিত ও হবেন…। (৯:১১১) আয়াতটি আকাবার শেষ চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আনসারদের প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হলেও নিজের বসতবাড়ি, সহায়Ñসম্পদ, আত্মীয়স্বজন সবকিছু ছেড়ে মুহাজির সাহাবীগণও সে শপথ’র বিষয়শর্ত পূর্ণাঙ্গরূপে পূরণে শামিল ছিলেন। তাঁদের যৌথ প্রতিরক্ষায় মদীনায়ে রাসূল’র নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়। আনসার ও মুহাজিরদের যৌথ প্রচেষ্টায় নবীজির সকল অভিযান ও কর্মসূচি অভাবনীয় সাফল্য পায়।
রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলের নিবেদিতপ্রাণ সাহাবীদের সাথে অপূর্ব এক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেন, যা নিছক জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির লোকেরা তেমনভাবে গ্রহণ করতে পারবে না। পারবেন তাঁরা, যাঁরা আল্লাহ্ ও রাসূলের বাণীকে সমুন্নত রাখা নিজেদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান বলে মনে করেন। আমাদের বাণিজ্যে কাক্সিক্ষত লভ্য হয় জাগতিক সম্পদ; কিন্তু তারা কামনা করেন আল্লাহ্্ ও রাসূলের সন্তুষ্টি। এ জন্য আল্লাহ্ ও রাসূলের জন্য তাঁদের অদেয় কিছুই ছিল না। মুমিন বান্দাদের উদ্দেশ্যে সমগ্র সৃষ্টিকূলের ¯্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান অধিপতি আল্লাহ্্ বলেন, ‘হে মুমিন বান্দারা, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্য জানিয়ে দেবো, যা তোমাদেরকে মর্মন্তুদ আযাব থেকে মুক্তি দেবে? তা হলো, তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখবে, তোমাদের মাল ও জান দিয়ে আল্লাহ্র পথে জেহাদ করবে। (অর্থাৎ তাঁর সন্তুষ্টিতে নিজেদের সবকিছু উৎসর্গ করবে) এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে’। (৬১:১০)
সাহাবায়ে রাসূল পবিত্র কুরআনের বাণীসমূহের বাস্তব রূপায়ন ছিলেন। আল্লাহ্ ও রাসূল যেমনটি চান, তাঁরা ঠিক তেমন রূপেই নিজেদের উপস্থাপন করতে সদা তৎপর ছিলেন। আল্লাহ্ তাআলাও তাঁদের প্রতি সন্তুষ্টি ও প্রতিদানের কথা বহু আয়াতে বর্ণনা করেন। পবিত্র কুরআনের সুরা তাওবার এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা হিজরতকারী ও আনসারদের প্রথম অগ্রগামী এবং যাঁরা উত্তমরূপে তাঁদের অনুগামী হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহ্র প্রতি সন্তুষ্ট। আর তিনি তাঁদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন উদ্যানসমূহ, যার তলদেশে প্রবাহিত ঝর্ণাধারা। তাঁরা সেখানে থাকবেন অনন্তকাল। তা হবে তাঁদের জন্য মহা সাফল্য’। (আয়াত নম্বর-১০০)
সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.) হলেন প্রকাশ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। এরপর ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়ে আসতেন, তারা অসহযোগিতার কারণে রিক্ত হস্ত হয়ে পড়েন। এ কারণে তাঁরা সকলে স্বচ্ছল ছিলেন না। উপরন্তু তাঁরা পৈত্রিক ভিটে বাড়ি ছেড়ে হিজরত করে আসতে থাকেন। তাই তাঁদের আর্থিক স্বাবলম্বিতাও খুব বেশি ছিল না। তবুও দ্বীন রক্ষার খাতিরে তাঁরা অনেকে দৈন্যতা স্বীকার করতেও দ্বিধান্বিত ছিলেন না। সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.) স্বচ্ছল ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর সামগ্রিক খেদমতের মত আর্থিক অবদানও ছিল অপরিমেয়। হযরত আবু হুরায়রা (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ (দ.) ইরশাদ করেন, ‘আবু বকরের মালÑসম্পদ আমাকে যেমনটি উপকৃত করেছে, অন্য কারো মালÑসম্পদ তেমন করেনি’। (তিরমিযী শরীফ) অর্থাৎ ইসলামে তাঁর আর্থিক অবদান অনন্য ও অতুলনীয়।
দু’টি বস্তু মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এক. নিজের প্রাণ ও দুই. অর্থবিত্ত। এ স্বচ্ছল যুগে যেখানে মানুষ টাকার জন্য মায়ের পেটেও ছুরি চালাচ্ছে, তখন অভাবÑঅনটন সত্ত্বেও সাহাবাগণ নিজে অভুক্ত থেকে পরস্পরকে খেতে দিয়েছেন, পরতে দিয়েছেন, নিজের সম্পদ থেকে হিস্যা দিয়েছেন। আনসার ও মুহাজির গণের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন হয়েছিল, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। সাহাবায়ে কেরাম সেই দু’ প্রিয় বস্তু উৎসর্গে নবীজির সাহাবার মধ্যে চলতো প্রতিযোগিতা। তাবুকের যুদ্ধে অর্থ সংগ্রহের জন্য নবী পাক (দ.) আহ্বান জানান। এখানে হযরত ওমর (রাদ্বি.)’র কাছে সে সময় বাড়তি সঙ্গতি থাকায় তিনি বিপুল অর্থ থেকে অর্ধেক নিয়ে নবীর দরবারে যান। তাঁর আশা, এবার তিনি আবু বকর (রাদ্বি.) কে টপকে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সিদ্দীকে আকবর (রাদ্বি.) ঘরের সবকিছুই নিয়ে এলেন। নবীজি তাঁর ঘরে কী রেখে এসেছেন জিজ্ঞেস করলে আবু বকর (রাদ্বি.) জবাব দিলেন, ‘আবক্বাইতু লাহুম আল্লাহা ওয়া রাসূলাহ্’। (তাঁদের জন্য আমি আল্লাহ্ ও তার রাসূলকে রেখে এসেছি)। [বর্ণনায় হযরত ওমর (রাদ্বি.) সূত্র : তিরমিযী ও আবু দাউদ] তাঁর শানে অবতীর্ণ হয় পূর্ণাঙ্গ সুরা লাইল।
আল্লাহ্র রাসূলের সাহাবায়ে কেরাম জানমাল দিয়ে শুধু ইসলামের সেবায় নয়, দুস্থ মানবতার সেবায়ও অগ্রগামী ছিলেন। রাতÑদিন, গোপনে প্রকাশ্যে সদাÑসর্বদা, স্বচ্ছলÑঅস্বচ্ছল সর্বাবস্থায় দানÑখয়রাতে তাঁরা ছিলেন মুক্তহস্ত। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাদ্বি.) বর্ণনা করেছেন, যেদিন আমার শ্রদ্ধেয় পিতা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সেদিন তাঁর হাতে চল্লিশ হাজার দীনার মজুদ ছিল। বর্ণনান্তরে চল্লিশ হাজার দিরহাম ছিল। ইসলাম গ্রহণ করার খুশিতে শোকরিয়া স্বরূপ তার সবটুকুই রাসুলুল্লাহ্র নির্দেশ মোতাবেক অকাতরে দান করে দেন। (মুফতী জালালউদ্দীন আমজাদীকৃত খুৎবাতে মুহাররাম’ দ্র.) সদরুল আফাদ্বিল মুরাদাবাদী (রহ.) বর্ণনা করেন, একদিন সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দীক (রাদ্বি.) আল্লাহ্র রাস্তায় দশ হাজার দীনার রাতে, দশ হাজার দিনে, দশ হাজার গোপনে এবং দশ হাজার প্রকাশ্যে দান করে দেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তাআলা অবতীর্ণ করেন, ‘যাঁরা নিজেদের অর্থসম্পদ খয়রাত করেন রাতে, দিনে গোপনে, প্রকাশ্যে তাঁদের জন্য নিজ পালনকর্তার নিকট রয়েছে এর প্রতিদান। আর তাঁদের না কোন ভয় আছে, না তাঁরা বিষণœ হবেন’। (২:২৭৪)
অন্য রেওয়ায়েতে রয়েছে, আয়াতটি শেরে খোদা মাওলা আলী (রাদ্বি.)’র প্রসঙ্গে বর্ণিত। তাঁর কাছে একবার শুধু চারটি দিরহাম ছিল। তিনি এক দিরহাম রাতে, এক দিরহাম দিনে, এক দিরহাম গোপনে, এক দিরহাম প্রকাশ্যে দান করেন। এ কারণে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বদান্যতার কথা উল্লেখ করে উক্ত আয়াতে তার প্রতিদানও ঘোষণা করেন। আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে তাদের ফয়েযÑবরকত ও তাঁদের আদর্শ গ্রহণের তাওফীক দিন, আমীন।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।