হামীম রায়হান :
‘ন কান্দিস ন কান্দিস ও মা
ন ফেলাইছ চৌগর পানি
রক্তের বদল তোর পোয়ায় দিয়ে
মুখের ভাষা আনি।’
অথবা,
‘বাংলাদেশত বাংলা ভাষা
হিন্দি হিন্দুস্থানত
চিনা দেশত চিনা ভাষা
আরবি ভাষা আরবত।
ঘরে বাআরে দেশর ভাইয়ান
বাংলা কথা কইও
ভাষার সম্মান দেশের সম্মান
চিন্তা গরি চাইও।’
চট্টগ্রামী বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান সুরকার, গীতিকার ও গায়ক গফুর হালী (১৯২৮-২০১৬) লিখেছেন গানের কথাগুলো। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ত্যাগের সেই মহিমার কথা তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় সুরে সুরে তুলে ধরেছেন। এমন অসংখ্য গান তিনি রচনা করে চট্টগ্রামের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। চাটগাঁ তথা আঞ্চলিক গানের সূচনার কথা স্পষ্ট করে জানা না গেলেও অনুমান করা হয় বাংলা গানের সূচনা থেকেই আঞ্চলিক গানের শুরু। চাটগাঁ আঞ্চলিক গানের ক্ষেত্রে যে ধারা চলে আসছিল তার আমূল পরিবর্তন হয় গফুুুর হালীর হাতে। তাঁর গানে চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনা ফুটে উঠেছে। আর এসব গান যেন হয়ে উঠেছে ইতিহাসের দলিল। এসব আঞ্চলিক গান যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষের মনে বিনোদন জুগিয়েছে। চিত্তের খোরাক যেমন হয়েছে এসব গান, বিত্তবানও করেছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে।
বাংলাদেশ যখন পাকিস্তান নামক শোষক রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। নিজেদের মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত। চারদিক শুধু লাশ আর লাশ, তখন গফুর হালী রচনা করেন-
তোর লয় আঁর লয় ন অইব অভাই
আঁই বাঙালি, তুই পাঠান,
তোর দেশে আর আঁর দেশে
দুই হাজার মাইল ব্যবধান।
আবার গাইলেন,
দিনত উডে সূর্যের রাইতত উডে চান
পরান খুলি গাইয়্যম আঁরা স্বাধীনতার গান।
তাঁর আধ্যাত্মিক গানগুলো আজ দেশে বিদেশে গবেষণার বিষয়। কিন্তু আজ কথা বলব চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গানগুলো নিয়ে। এ গানগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নরনারীর প্রেম, বিরহ, বিশেষ করে নারী মনের দুঃখ, ব্যথা বিচিত্র আঞ্চলিক ভাষিক বৈচিত্রের ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আর তাই তো এসব গান যেন হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের অন্তঃপুরবাসিনীর মনের গান। এখনো হাটে, মাঠে, ঘাঠে, পথে প্রান্তরের মানুষ এসব গান গুন গুন করে গায়।
তৎকালীন মানুষ বিদেশ যাত্রা করত রেঙ্গুনে। অপরাজেয় কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও জীবিকার খোঁজে গিয়েছিলেন রেঙ্গুন শহরে। প্রিয়জন রেঙ্গুন যাবে আর প্রেয়সীর মনের বিরহ গফুর হালী গানের কথায় ফুটিয়ে তুলেন। এ গানটি শুধু গান হিসেবে নয়, এখান থেকে জানা যায় তৎকালীন রেঙ্গুনের সমৃদ্ধির ইতিহাস সম্পর্কে।
অ-শ্যাম রেঙ্গুম ন যাইয় রে
হনে খাইবো রেঙ্গুমর কামাই রে শ্যাম।
অ-শ্যাম শ্যামরে রেঙ্গুমর রেশমি শাড়ি
ন পিন্দিয়ম মুই অবলা নারী রে শ্যাম।
অথবা,
ননদিনীরে ও ননদিনী
তোর ক্যান বড় ভাই
ও তার দয়া মায়া নাই
বিয়া গরি বিদেশ গেল গৈ
ঘরত বৌ ফেলাই।
সোয়ামী যার পরবাসে
যার জ্বালা সে জানে
কোয়া ন যায় সোয়া ন যায়
জ্বলে রাইতে দিনে
মিডা খাইলে তিতা লাগে
কইলজা পুরি হই যায় ছাই।
১৯৭০ সালে তিনি রচনা করেন একটি বিয়ের গান। বিয়ের গান এখন শহুরে জীবনে অপরিচিত হলেও গ্রামীণ জীবনের একটা অংশ-
আইওরে আইওরে কুডুম
দুলা হাঁজাইতাম।
কাঁচি হলইদে আনরে বাডি
আনরে মিডা পান
কুডুম আইওরে।
ভালা গরি বইও দুলা
পশ্চিম মিক্ষা হই
আঁক কুলারে মাথাত লইত
দুলার মা গেল কই।
মনের মানুষ যখন আসবে বলে আসে না, তখন মনের কত বেদনা জমে তা রইস্যা বন্ধুকে গফুর হালী জানায়-
আইসতা কই রইস্যা বন্ধু
কেএনে তুঁই ন আইলা
আশা ন পুরাইলা মনর কথা ন কইলা।
দুয়ারত ন দিলাম তালা
নিভাইতাম মনর জ্বালা
পীরিতির আশা দি-দি
আঁরে কেনে ভারাইলা।
আরেকটি গানে লিখেন-
আঁর কথা পুছার ন গইজ্য
আঁই বঅর ভালা নাই
চিন্তায় চিন্তায় মরি যাইর গৈ
তুই বন্ধুয়াল্লাই।
১৯৬৫ সালে রচিত একটি গানে তিনি রম্য করে বর্ণনা করেন এক যুবকের মনের বেদনার কথা। তার বড় ভাই দুটো বিয়ে, কিন্তু তাকে একটাও বিয়ে করায় না। ভাই দুটো বৌ নিয়ে পুন্নুর পুন্নুর কথা বলে, আর তা দেখে কষ্ট বাড়ে তার-
আঁত্তে কিছু গম ন লার,
বদ্দা গইর গে দুয়া বিয়া
আঁরে ন গরার।
আঁই গরি বিলর কাম
বদ্দা থাকে ঘরত বই,
পুন্নুর পুন্নুর কথা কয়
ভাবি দোনোয়ারে লই
আঁর দিন্নান কেএনে হাডে
কেয় ন গরে এই বিচার।
ভাবি দেবরের স্নেহময় সম্পর্ক নিয়েও লিখেন গান। ভাবির কান্না দেখে দেবরের জিজ্ঞাসা-
ও আদরর ভাবিরে তুঁই
কান্দর কিয়ল্লাই।
বদ্দা কিছু কইয়ে না
মন কেয়াল্লাই কান্দের না
মনত কি দুখ কওনা তোঁয়ার
আঁরে বুঝাই।
এরপর যে গানটি নিয়ে বলব সেটি হতে পারে প্রিয় মানুষটির বিদেশ যাত্রা বা চিরবিদায়ের বিরহে রচিত। মানুষটি যখন সুখের সময় চলে যায় তখন কত কষ্ট লাগে তা যেন তুলেছেন সুরের টানে টানে-
এতদিনে বুঝিতরে পাইল্লাম
আঁরল্লাই বুলি তোত্তে নাই আদর
হাতে হাত্তান রাখি কঅলিরে
ন ছারিবি বুলি জনমভর। ওরে জনমভর।
শ্বশুর বাড়িতে থেকে বৌয়ের বেদনার কথা বলছেন গফুর হালী। মাঝিকে মিনতি করে বলেছেন যেন মহেশখালী গিয়ে বাবা মাকে তার খবর জানিয়ে দেয়। শাাশুড়ি ননদের জ্বালার কথাও বলা হয়েছে এ গানে। গানটি ১৯৯৯ সালে রচিত। এখন মোবাইলের যুগ, তখন কতই না কষ্টের ছিল মানুষের সাথে যোগাযোগ করা-
ও মাঝি ভাই
মইষখালি কনো যাইবানি
আঁর খবরগান ভাই জানরে
কওনা পৌঁছাই দিবানি।
শাশুড়ি ননদীর জ্বালা
সোনার অঙ্গ গইরলাম কালা
এতো সাধন সাধি চাইলাম
আপন ন অইলো সোয়ামি।
চট্টগ্রামের মানুষের সাথে সাগরের মিতালি। তাদের জীবনে সাগরের একটা প্রভাব আছেই। সাগর থেকে যে তুফান আসে তাও যে চাটগাঁর মানুষকে মোকাবিলা করতে হয়। তাই তো গানে লিখেন-
চাইর মিক্ষাতুন আইয়ের তুয়ান আল্লা
চাইর মিক্ষাতুন আইয়ের তুয়ান
কন মিক্ষা ধইরগমরে চুয়ান।
কুলত যাইবার আশা গরি
বেবাম সাগর দিলাম পাড়ি
মাঝে পাইয়ে টুইট্যা বয়ান
ডুবি যার আঁর সাম্পান্নান।
পান আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির একটা অংশ। মনের মানুষকে আদর করে পান খাওয়াতে চাই মানুষ। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে কথা বলা যেন প্রেমের সিম্বল।
তিন কুইন্যা পানর খিলি
শাড়ির কোনাত রাক্ষি বানাই
উগ্গা মনর মানুষ পাইলে
নিজর হাতে দিতাম খাবাই।
পানর রসে টোঁট লাল হইত
হাসি হাসি কথা কইত
সোহাগ গরি হাতে ছিড়ি
আরে আদ্দান খাবাই দিত
শরমে আঁই চৌগ নামাইতাম
মাথাত দিত হাত্তান বুলাই।
১৯৭৭ সালে লিখেন-
পানর মজা চুন শুয়ারী
ভাতর মজার তরকারি
সুন্দর মুখর মিডা হাসি
লই গেল গৈ মন কারি।
কৃষ্ণের বাঁশির সুর যেন যুগ যুগ ধরে রাধাকে টেনে আনে। সকল প্রেমিক মনে রাধা কৃষ্ণ যেন প্রেমের যুগলবন্ধী হয়ে মিশে আছে। কৃষ্ণ যেন আজো নিশি রাতে বাঁশি বাজিয়ে রাঁধাকে ডাকে-
নিশি রাইতে বাঁশি বাজায় হনে
অবলার পরাননান ধরি টানে।
ও সখীরে
যার বাঁশি হুনতে এমন
জানি না সে মানুষ কেমন
একবার তারে দেখতে চাই মন।
আরেক গানে গাইলেন-
প্রেম কারে কয় বুঝে কয়জনে
যেমন জাইনতো শিরি ফরহাদ
চ-িদাশ আর রজকিনী
জাইনতো লায়লা মজুনে।
১৯৬৪ সালে রচিত তাঁর প্রেমের গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়। এখনো তরুণ মনের প্রেমের গান হয়ে গানটি বাজে। অনেক শিল্পী এ গান গেয়ে শ্রোতা প্রিয়তা পেয়েছে। গানটি হল-
রসিক তেল কাজলা
ঐ লাল কোত্তাওয়ালা
দিলো বড় জ্বালারে
পাঞ্জাবিওয়ালা।
বারবি কাটা তার চুলর বাহার
মুচকি হাসি হাসি পরান লইযার
ঐ বাবরি চুল ওয়ালা
ঐ লাল কোত্তাওয়ালা।
গফুর হালী হলো সাধারণের শিল্পী। তাই তাঁর গানে পাওয়া যায় সাধারণ মানুষের কথা। তাদের প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা।-
রিক্সা চালাও রসিক বন্ধুরে
রিক্সা চালাও রসিক বন্ধু
সামনের রাস্তা দিয়া
অভাগিনী চাইয়া থাকি
জানালা মেলিয়ারে।
এভাবে তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন যা চট্টগ্রামে ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। চাটগাঁয় মানুষের প্রেম ভালোবাসার সাথে গফুর হালী নামটি জড়িয়ে থাকবে ততদিন যতদিন চট্টগ্রামের ভাষা থাকবে, সংস্কৃতি থাকবে। একটি জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম দেখেছিলাম ‘গফুর হালীকে ভুলে গেছে মানুষ! ‘ এমন খবর সত্যিই মনকে বড় ব্যথিত করে। আসকর আলী প-িতের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গফুর হালী আমৃত্যু চাটগাঁইয়া গান লিখে ও গেয়ে গেছেন। চাটগাঁর গান মানেই আবদুল গফুর হালী। গফুর হালী যেন মিশে গেছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতির সাথে। তাই আঞ্চলিক গানের এই সুর সম্রাটকে যদি আমরা ভুলে যাই তবে হয়ত ‘আত্ম বিস্মৃতি’র যে অপবাদ আছে তা হয়ত সত্যি হবে। গফুর হালীকে নিয়ে ইতোমধ্যে কিছু কাজ হয়েছে, তবে যতটুকু হওয়া দরকার তা হয়ত এখনো হয়নি।