রতন কুমার তুরী
আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পরেই চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। অর্থাৎ ২৭ জানুয়ারি সকাল থেকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের প্রচারের কাজটি প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।
অনেক জায়গায় প্রার্থীরা একাধিকবার যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে মূল লড়াই হলেও আকর্ষণীয় লড়াই হবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে কারণ এক ওয়ার্ডে একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে মাঠে থাকায় জনগণও বুঝে শুনে ভোট দেবেন বলে মনে হচ্ছে।
বর্তমানে মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা সভাসমাবেশে জনকল্যাণের জন্য বিভিন্ন কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও নির্বাচিত হওয়ার পর তারা কীভাবে তা পূরণ করেন তা দেখার বিষয়। বিগত বছরগুলোতে মেয়র প্রার্থীরা চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তার অনেকটাই পূরণ করতে না পারায় অনেকেই এই বিষয়টিকে বাস্তবায়নের জন্য শতভাগ প্রতিশ্রুতি চাইছেন। অন্যদিকে মশক নিধন, পরিচ্ছন্ন কর্মীদের মাধ্যমে শহরকে নিত্যদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি নজর দেয়া, স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োনীয় জিনিস সিটি কর্রপোরেশনের মাধ্যমে সুলভমূল্যে পাওয়া, চট্টগ্রাম সিটিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাসহ রয়েছে জনসাধারণের অসংখ্য দাবি। বিশেষ করে শহরের নালানর্দমা পরিষ্কার করণের মাধ্যমে শহরবাসীদের বর্ষাকালে পানিবন্দি থেকে মুক্তি দেয়াই নির্বাচিত মেয়রের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নগরবাসী বর্ষাকালে চরম দুভোর্গের শিকার হয়েছে। বর্ষার সময় নগরীর অনেক জায়গায় পানি ঢুকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। তাছাড়া নগরীর পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা আরো আধুনিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্ষার সময় আমরা দেখতে পাই নগরীর ড্রেনগুলো ভরে আছে অজ¯্র পলিথিন এবং নোংরা আবর্জনায়। এসব নালানর্দমা বর্ষা আসার আগেই যাতে শতভাগ পরিষ্কার হয়ে যায় সে বিষয়ে নির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলরদের নজর দিতে হবে।
অপরদিকে শহরের গরিব এবং মধ্যবিত্তদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রকল্পের অন্তর্ভুত করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের পথ নিতে হবে। এইসব পরিকল্পনা শুধু বাস্তবায়ন করলে হবে না এসব পরিকল্পনার সুবিধাভোগী আসলে কারা তা সরেজমিনে তদারকি করতে হবে।
শহর এলাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে হলে সিটি কর্রপোরেশনের তত্ত্বাবধানে এবং অর্থায়নে আরো কিছু নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে এবং সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে মেধাবী এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। শহরের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য নতুন হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জনবান্ধব পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে সবসময় জনগণই উপকৃত হয় তবে, তার জন্য মেয়রের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন হবে। চট্টগ্রাম শহরে মানুষের বিনোদনের মত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বললে চলে, যা আছে তা শহরের বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত, নবনির্বাচিত মেয়র আবালÑবৃদ্ধÑবনিতার জন্য কয়েকটি পার্কের ব্যবস্থা করতে পারেন। পার্কসমূহে শিশুদেরও বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা যায়। একশ্রেণির ব্যবসায়ী ফুটপাত দখল করে থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, এসব বিষয়ে মেয়রকে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অন্যত্র ব্যবসার জন্য জায়গা দেয়া যায় কিনা তা যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।
নগরীর আইন শৃঙ্খলা যাতে সহনীয় মাত্রায় থাকে তা মেয়র এবং কাউন্সিলরদের নিশ্চিত করতে হবে। এবিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব শতভাগ পালন করতে পারে সেদিকেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে নজর রাখতে হবে। নগরীতে ছিনতাইকারীর উৎপাত বেড়ে গেছে। এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। নগরীর ঐতিহাসিক স্থান, বাড়ি, স্থাপনাগুলো যাতে কোনো কুচক্রী মহল ক্ষমতা কিংবা টাকার জোরে দখল করে নিতে না পারে, নগরপিতাকে সেবিষয়ে সবসময় সজাগ থাকতে হবে কারণ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে এবারের নির্বাচিত মেয়রের কাছে জনপ্রত্যাশা ব্যাপক বিশেষ করে বর্ষার সময় শহরময় জলাবদ্ধতার বিষয়টি প্রধান। আমরা প্রত্যাশা করবো, নবনির্বাচিত মেয়র চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের এই সমস্যাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখবেন। অবশ্য মেয়র প্রার্থীরা ইতিমধ্যে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উপরোক্ত বিষয়সমূহের অধিকাংশ স্থান দিয়েছেন, এখন দেখার পালা নতুনভাবে নির্বাচিত হলে তিনি ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো ভবিষ্যতে কতটুকু বাস্তবায়ন করেন। কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রাম নগরের সীমানা বাড়াবে। এ ব্যাপারে এখন থেকেই পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
মেয়র প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির তালিকায় এমন অনেক বিষয় এনেছেন, যা সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন নয়। তবে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম নগরের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এসব বিষয়ে তারা সরকার ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেনÑএটি ইতিবাচক দিক। আবার এ জন্য বিশেষজ্ঞরা বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে সিটি কর্পোরেশনের ক্ষমতা ও কাজের পরিধি বাড়ানোর কথা বলছেন। এটি সিটি গভর্নমেন্ট কনসেপ্ট এর মধ্যে পড়ে। উন্নত বিশ্বে সিটি কর্পোরেশন নগর বা অঞ্চলের প্রায় সব বিষয়ই দেখাশোনা করে। আমাদের এখানে আমলাতান্ত্রিক কূটকৌশলের কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হতে পারছে না। এ ব্যাপারে আরও বিশদ আলোচনা প্রয়োজন।
তবে সাধারণভাবে এ কথা বলা যায়, নগরবাসী স্বস্তিতে এবং সকল প্রকার নাগরিক অধিকার নিয়ে নগরজীবন অতিবাহিত করতে চায়, এই চাওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক কেননা তারা তাদের শ্রম, মেধা দিয়ে, ব্যবসা বাণিজ্য, সরকারিÑ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের মাধ্যমে নগর অর্থনীতি, নগর জীবন সচল রাখছেন। নগরের প্রান্তিক মানুষেরা নগরীকে কর্মমুখর রাখছেন, সুতরাং তাদের জীবনযাপন সহজ করতে নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরগণ দৃষ্টি দেবেনÑএটি নগরবাসী প্রত্যাশা করে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক