চন্দ্রিমা

অরূপ পালিত

চন্দ্রিমা অফিসের সবাইকে নিয়ে ঈদের ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে। বসের সাথে চন্দ্রিমা তেমন মিশতে চায় না। কারণ এ লোকটির নজর খারাপ। চাউনিতে শয়তানিভাব স্পষ্ট। সারাদিন অফিসের সবাই পাহাড় দেখে সমতলে নেমে গেছে। ফিরবে না বলে চন্দ্রিমা একা রয়ে গেছেন।
আজকের বৃষ্টি যেন চন্দ্রিমার সাথে আদিখ্যেতা শুরু করতে লাগলো। এমন জোরে বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তাঘাট ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু চন্দ্রিমার একচুলও ভিজছে না। তবে গা ঘিন-ঘিন করছে। মনে হচ্ছে শরীরের ওপর থেকে কিছু অংশ কেটে ফেলে দিতে পারলে ভালো হতো।
চন্দ্রিমার কাঁধের ওপর কারো হাত রাখা মোটেই পছন্দ করে না। মনে হয় ওর সমন্ত শরীরের ভার চন্দ্রিমার কাঁধে রেখেছে। কালো মেঘ পাহাড়কে ঢেকে রেখেছে। অঝোরে বৃষ্টির সাথে সাথে সন্ধ্যে নেমে আসছে। পাহাড়ের চারদিকের ল্যাম্পপোস্টগুলো গোলাপী আলোয় জ্বলে উঠলো।
শরীরের ওপর আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আর ল্যাম্পপোস্টের নিচের আলোতে ঝিরঝির করে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকা বৃষ্টিরকণাগুলোর মধ্যে অনেক তফাত মনে হচ্ছে। নিবিড়ভাবে তাকালে মনে হয় ল্যাম্পপোস্টের বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঙেন কেমন বড় বড় লাগছে। চন্দ্রিমার মনের মধ্যে কি চলছে কোনো উপমা দিয়ে তার প্রকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। বৃষ্টি যতই তীব্রতর হতে থাকে অনুভূতির মাত্রা আরও গাঢ় হতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছে চন্দ্রিমা। মনে হচ্ছে সবাই চন্দ্রিমাকে উপহাস করছে।
পাহাড়ের টিলাগুলো খিলখিলিয়ে হাসছে যেন। চন্দ্রিমা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা কষ্ট ও আনন্দ সব বুঝতে পারেন। সে যে পাহাড়িকন্যা। পেছনে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। রাগে-ক্ষোভের আগুন হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখের কোণে। অসহায় শিপুর কোমল মুখটি বারেবারে ভেসে উঠছে চোখে। মনে হয়, তারা যেন ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দেয় চন্দ্রিমাকে। দুর থেকে দাঁড়িয়ে ইশারায় কে যেন বলে, আমি আছি তো।
এই পাহাড়ে দুজনে হাত ধরে হাঁটা, অনেক সুখের মুহূর্তগুলো চন্দ্রিমার ভেতরটাকে এতটাই শিহরিত করছে যে, মনে হচ্ছে শিপু পেছন থেকে চন্দ্রিমাকে ভালোবেসে হাত ধরেই রেখেছে। কিসে যেন আটকে যাচ্ছে পা। সামনের দিকে এগোচ্ছে না আর।
চন্দ্রিমার এখন রাত নেমে আসলে ভয় হয়। চোখের পাতা দুটো এক করতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। সারারাত ছটফট করতে থাকে বিছানায় আরেকটি সকালের জন্য। রাত শেষে ভোরের আলোয় চোখের পাতায় ক্লান্তি নামে। কিন্তু ঘুম আসে না। ঘুমকাতুরে মানুষটির অস্তিত্ব টের পায়। জানালা খুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে। কান্নাভেজা চোখে এদিক-ওদিক মানুষটির ছায়া খুঁজে দিশেহারা হয়ে যায় চন্দ্রিমা। পারে না ছুঁতে শিপুর ছায়া। ঘরের বাইরে বের হতেই অদ্ভুত একটু মিষ্টি বাতাসে শীতলতা অনুভূত হয়। বাতাসে শিপুর গন্ধ খুঁজে বেড়ায় চন্দ্রিমা। বারেবারে শিপুর মায়াবী ব্যথাতুর মুখখানা চোখের কোণে ভেসে ওঠে। মনে হয় ওই তো শিপু শিউলিফুল তুলতে গেছে। এসে বলবে, এই চন্দ্র চোখ বুজতো। মাথার ওপর শিউলিফুল ছিটিয়ে বলবে, আমাকে আমার পাও না দিবে না।
ভাবতে থাকে চন্দ্র। শিশির ভেজা ঘাসে হাঁটলে শিপুর মতো কেউই পায়ের পাতা মুছে দিয়ে বলবে না। চন্দ্র আর না, ঠান্ডা লেগে যাবে। কেউ আজ জড়িয়ে নিয়ে বলবে না, এই আমার পাহাড়িফুল। তুমি সব ফুলের চেয়ে আলাদা।
শিপু সবেমাত্র ভার্সিটি থেকে বের হয়েছে। অধ্যাপনা ছাড়াই আর কোন চাকরিতে প্রবেশের ইচ্ছে নেই। সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে এমন মেধাবী ছাত্রকে ভার্সিটি কোন অবস্থাতেই হাতছাড়া করবে না।
চন্দ্রিমারও বড়ো শখ শিপুকে ভার্সিটিতে টিচার হিসেবে পেতে। কারণ শিপুর কোয়ালিটি এবং কোয়ান্টিটি দুটোই আছে। সুন্দর বা হ্যান্ডসাম পুরুষ বলেই ভার্সিটিতে অনেক মেয়ে আছে শিপুকে বেশ পছন্দ করে। তার মধ্যে চন্দ্রিমাও একজন। চন্দ্রিমা পাহাড়িকন্যা হলেও চেহারার নান্দনিক সৌন্দর্য বাঙালিকেও হার মানায়। ভার্সিটিতে অনেক ছেলেই আছে একবার দেখলে আবার দেখার জন্য পেছন ফিরে তাকায় ওর দিকে।
চন্দ্রিমা শিপুকে যে ভালোলাগে সেটা সরাসরি শিপুকে বলে ফেলে। দুজনের অনেক দিনের জানাশোনা।
শিপু চন্দ্রিমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। শর্তসাপেক্ষে ভালোবাসা মেনে নিয়েছে। প্রথম শর্ত নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত যতদিন ভার্সিটি থেকে ভালো রেজাল্ট করে বের না হবে ততোদিন শিপুর কাছে আসতে পারবে না। শিপু ভার্সিটিতে জয়েন্ট করার পর চন্দ্রিমা একদিনের জন্যও শিপুর কাছে যায়নি।
চন্দ্রিমার গ্রাজুয়েশন শেষ। পাহাড়ের একটি কলেজে জয়েন করার জন্য নিয়োগপত্র পেয়েছে। এবার বন্ধুমহল ধরে বসলো। চন্দ্রিমা সেখানে একা যাবে না। দু’জনকে এবার সাতপাকে বাঁধা অবস্থায় দেখতে চায়।
০২
চন্দ্রিমা এবং শিপুর সিদ্ধান্ত। বাঙালি এবং আদিবাসী চাকমারীতি মেনে বিয়ে করবে। ভেতর ভেতর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ দুজন পরিবারের সম্মতি পেতে। দুই পরিবারের আপত্তি টলাতে পারেনি দুটি প্রাণের ভালোবাসাকে। সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে জীবনের যাত্রা শুরু হয়। সকালের সোনা রোদ্দুরও দু’জনকে হিংসা করে। শিপু প্রতিদিন কলেজ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে চন্দ্রিমাকে।
চন্দ্রিমা খেয়াল করে বিশেষ করে ওর ক্লাস যখন শুরু হয় সব স্টুডেন্ট ক্লাসে উপস্থিত থাকে। ইংরেজিতে মনে হয় সব স্টুডেন্টরা পারদর্শী হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত সুন্দর বলে। তাই সব স্টুডেন্ট চন্দ্রিমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। চন্দ্রিমার মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে। না, সব ধারনা ভুল। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয় তাকে। চন্দ্রিমা এই চাকরি করতে রাজি না। শিপুকে বললে শিপু বলে তোমার যা ইচ্ছে।
শিপু চন্দ্রিমাকে পূর্ণস্বাধীনতা দিয়েছে। ইংরেজির ওপর ভালো দখল আছে বলে বিদেশি বায়িং হাউসে চাকরি নেয়। অনেক টাকা বেতন। গাড়িতে আসা-যাওয়া। বছর ঘুরতে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে থাকে মানসিকতায়। এখন সন্তান নেবার কোন ইচ্ছে নেই। বিদেশিনীভাব চলে আসে। বিদেশ ভ্রমণে কোরিয়া যাবার জন্য উতলা হয়ে ওঠে চন্দ্রিমা।
ইদানিং চন্দ্রিমার সময়ের বড় অভাব। শিপুর চন্দ্রিমাকে এখন অচেনা লাগে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে চন্দ্রর কোলে মাথা রেখে আর ঘুমাতে পারে না। চন্দ্রিমাকে ছাড়া শিপুর ঘুমানো খুবই কষ্টের। চন্দ্রিমা যতক্ষণ না শিপুর মাথা কোলে নিয়ে চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে না দেয় ততক্ষন ঘুম আসে না শিপুর।
রাত যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। মুখে কিছু বলতে পারে না শিপু। চন্দ্রিমা চলে যায় কোরিয়া। অদৃশ্য কালো থাবায় লকডাউনে পড়ে যায় গোটা বিশ্ব। প্রথম ধাক্কাতে কাবু হয়ে যায় শিপু। কেউ কাউকে স্পর্শ করতে রাজি নয়। শিপুকে আইসিইউতে ভর্তি করা হলে পাশে পায় না কাউকে। চন্দ্রিমার মিষ্টিহাসিটা বারে বারে ভেসে ওঠে চোখের কোণে। ভারী হয়ে আসে চোখের পাতা। টুৃংটাং কাচের চুড়ির আওয়াজ আসছে। কে যেন কানের কাছে এসে বলে, আমি মাথায় হাত রেখেছি। তুমি ঘুমাও।
০৩
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিপুর লাশ দিয়ে দেয় আঞ্জুমানে মফিদুলের কর্মীদের কাছে। শিপুর লাশ নেবার জন্য কেউ আসেনি। কোন ঠিকানা ছিল না শিপুর।