পর্যায়ক্রমে বাকি ওয়ার্ডগুলো লকডাউন হবে : চসিক মেয়র
# লকডাউন এলাকায় সাধারণ ছুটি # নমুনা দিতে থাকবে পৃথক বুথ # ওষুধের দোকানও বন্ধ থাকবে # ই কমার্সের মাধ্যমে এবং ভ্যানের মাধ্যমে পণ্য যাবে ডোর টু ডোর
ভূঁইয়া নজরুল<
সবার আগে লকডাউনে চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড। কাল মঙ্গলবার ১৬ জুন মধ্যরাত ১২টার পর থেকে ২১ দিনের জন্য লকডাউন হচ্ছে পুরো উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড এলাকা। এই সময়ের মধ্যে ঘর থেকে কোনো মানুষ বের হতে পারবে না। এমনকি ওষুধের দোকানও বন্ধ থাকবে। আর পুরো এলাকার লোকদের সহায়তার জন্য থাকবে সিটি কর্পোরেশন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন। এছাড়া রেড জোনে থাকা বাকি ৯ ওয়ার্ডগুলো হলো- ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড, ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড, ২০ নম্বর দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড, ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ড, ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ড, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ড, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ড ও ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ড।
রোববার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিলনায়তনে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের উপসি’তিতে সভায় আলোচনার ভিত্তিতে সবার আগে ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডকে লকডাউন ঘোষণার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এবিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া নির্দেশনার আলোকে আমরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা বসে সবার আগে ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলীকে লকডাউন করার সিদ্বান্ত নিয়েছি। এই ওয়ার্ডে আগামীকাল মঙ্গলবার মধ্যরাত ১২টার পর থেকে আগামী ২১ দিনের জন্য লকডাউন থাকবে।‘
এই ওয়ার্ড লকডাউন করা হলেও চট্টগ্রামের আরো ৯টি ওয়ার্ড বাকি থাকবে। সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত কি জানতে চাইলে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন,‘ বাকি ওয়ার্ডগুলোর বিষয়ে আমরা শিগগিরই সিদ্ধান্ত নিবো। তবে আগে উত্তর কাট্টলী দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে বাকি ওয়ার্ডগুলো লকডাউন করা হবে। বাকি ওয়ার্ডগুলো একসাথেও লকডাউন করা হতে পারে কিংবা পর্যায়ক্রমে করা হতে পারে।’
এভাবে খণ্ড খণ্ড লকডাউন করে কি সমাধান হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে সিটি মেয়র বলেন,‘ চট্টগ্রামে বন্দর রয়েছে। ইপিজেডসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা রয়েছে। তাই এখনই পুরো নগরী বন্ধ করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। তবে এড়্গেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হবে এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করা হবে।’
সবার আগে উত্তর কাট্টলী কেন?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১৪ দিনে প্রতি লাখে ৬০ জন মানুষ আক্রান্ত হলে সেই এলাকাকে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হবে। তারপরও সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন এবং পুলিশ সুপার সম্মিলিতভাবে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন দিতে পারবে। মন্ত্রণালয় থেকে চট্টগ্রামের ১০টি ওয়ার্ডকে রেড জোন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই ১০টি জোনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত রয়েছে ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডে। প্রাপ্ত তথ্যমতে এই ওয়ার্ডে ১৬১ জন, এছাড়া ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে ১৪৫ জন, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে ১০৫ জন, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে ৮১ জন এবং বাকি ওয়ার্ডগুলোতে ৪৬ জন বা এর বেশি রয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রাপ্ত তথ্যে সবার আগে চকবাজার ওয়ার্ড লকডাউন হওয়ার কথা ছিল, কিন’ তা করা হয়নি। কেন করা হয়নি তা জানতে গতকাল বিকেলে সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয় সভায় উপসি’ত একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, লকডাউন দেয়ার জন্য একটু বিক্ষিপ্ত এলাকাকে খোঁজ করা হচ্ছিল। যাতে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। চকবাজার অনেক বেশি ঘনবসতিপূর্ণ এবং এই এলাকার উপর দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতের মাধ্যম। তাই তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। তুলনামূলকভাবে দড়্গিণ কাট্টলী ওয়ার্ড ডিটি রোডের পশ্চিমের সাগর পর্যন্ত পৃথক একটি এলাকা। তাই এলাকাটি সবার আগে বিবেচনা করা হয়েছে।
১০ নম্বর ওয়ার্ডের সীমা
উত্তরে সিটি গেট থেকে পশ্চিম দিকে মোসত্মফা হাকিম কলেজ রোড হয়ে সোজা পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। পূর্ব দিকে ডিটি রোড হচ্ছে ওয়ার্ড বাউন্ডারি। দড়্গিণে অলংকার মোড় থেকে ডিটি রোড হয়ে সিডিএ মার্কেটের সামনের দিকে সাগরিকা রোড হয়ে সোজা পশ্চিম দিকে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম হয়ে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা এই ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে।
কেমন হবে লকডাউন?
এই এলাকার কোনো মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। এমনকি মসজিদ, মন্দির, গির্জায়ও কেউ উপাসনা করতে যেতে পারবে না। শুধু মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেম এবং মন্দিরের পুরোহিতরা থাকবেন। বন্ধ থাকবে সব দোকানপাট এমনকি ওষুধের দোকানও। তাহলে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিভাবে পাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন,‘ এবার কঠোরভাবে লকডাউন পালন করা হবে। পুরো এলাকায় লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে সোমবার এলাকায় সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরকে নিয়ে বৈঠক করে কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে। এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক এবং সিটি কর্পোরেশনের টিম থাকবে। এছাড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনও থাকবে।’ লকডাউন বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদিউল আলম বলেন,‘ এবারের লকডাউন সত্যিকারভাবে খুব কঠিন হবে। আগামী ২১ দিন কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না।’
সোমবার সকাল থেকে এলাকায় মাইকিং শুরু হবে
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, এলাকার লোকজন যাতে মানসিকভাবে প্রস’ত হতে পারে এজন্য আজ সোমবার সকাল থেকে পুরো এলাকায় মাইকিং শুরু হবে। এলাকায় লিফলেট বিলি করা হবে। কি করা যাবে, কি করা যাবে না, কোথায় কি সুবিধা পাওয়া যাবে সব লেখা থাকবে সেই লিফলেটে। আর সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দিন সময় পাওয়ায় মানুষ নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখারও সুযোগ পাবে।
এলাকায় থাকবে নমুনা বুথ এবং অ্যাম্বুলেন্স
করোনা আক্রান্ত কিংবা সন্দেহভাজনরা যাতে টেস্ট করাতে পারে সেজন্য একাধিক নমুনা বুথ থাকবে এলাকায়। একইসাথে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতাল সুবিধা দেয়ার জন্য থাকবে অ্যাম্বুলেন্স। এবিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের একান্ত সচিব ও সরকারের উপ সচিব আবুল হাসেম বলেন, ‘এলাকার মানুষ যাতে সিটি কর্পোরেশনের কন্ট্রোল রুমে ফোন করার সাথে সাথে সব পায় আমরা সেই ব্যবস্থাকরবো। ঘরে বসেই যাতেই সব ধরনের পণ্য পেতে পারে সেই আয়োজনও থাকবে। তারপরও এই এলাকা থেকে কেউ বের হতে পারবে না এবং অপর এলাকা থেকে কেউ এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না।’
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিভাবে পাবে মানুুষ
২১ দিনের জন্য খাবার সহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মানুষ কোথায় পাবে? এতো দ্রব্য তো মজুদ করেও রাখা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদিউল আলম বলেন,‘ এজন্য আমরা ই কমার্সের মাধ্যমে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের বিধান চালু করছি। একইসাথে স্বেচ্ছাসেবক ও সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ভ্যানের মাধ্যমে এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হবে। মানুষ অর্ধের বিনিময়ে ভ্যান থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে পারবে।’
লকডাউন এলাকার জন্য থাকবে সাধারণ ছুটি
যেহেতু লকডাউনের কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। তাহলে এই এলাকার যেসব মানুষ নগরীর অন্য প্রানেত্ম চাকরি করে তাদের কি অবস্থাহবে? এমন প্রশ্ন করা হলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, তাদের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হবে। তারা কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে যেতে হবে না।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ ঢাকার দুই মেয়র এবং স্থানীয় সরকারের মন্ত্রীসহ সরকারের উর্ধতন কর্তাদের নিয়ে জুম ভিডিও মিটিং হয়েছিল গত শুক্রবার। সেই সভায় রেড জোনের লকডাউনে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার পর আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা লকডাউনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। আর চট্টগ্রামে এপর্যন্ত ৫ হাজার ৮৪ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীতে রয়েছে ৩ হাজার ৫৬৭ জন এবং বিভিন্ন উপজেলাগুলোতে ১ হাজার ৫১৭ জন। চট্টগ্রামে এপর্যন্ত মারা গিয়েছে ১১৭ জন। অপরদিকে উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হাটহাজারিতে ২৭৭ জন। এছাড়া পটিয়ায় ২২০ জন, সীতাকুণ্ডে ১৮৮ জন এবং বোয়ালখালীতে ১৬৭ জন রয়েছে।